যোগ্যতম না হতে পারলে যে সমাজই তাকে বহিষ্কার করে দিতে চায়, ইতিহাসই সে সাক্ষ্য দিয়েছে বারবার। যে প্রজন্মের মানুষেরা চল্লিশের গণ্ডি পেরিয়ে তাই বার্ধক্যের দিকে ক্রমশ এগোচ্ছিলেন, অনেকখানিই ব্রাত্য হয়ে পড়লেন প্রযুক্তিময় ঝকঝকে নতুন সামাজিক প্রেক্ষাপটে। সন্তান যে তৎপরতার সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার খুঁটিনাটি আয়ত্ত করে, অভিভাবকের তা শিখতে অনেক সময় লেগে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে যে খবর বহুদিন আগেই জেনেছে সন্তান, অভিভাবকের জীবনে তা হাজির হয় আনকোরা চমকের মতো।
সকাল সকাল যে একগাদা মেসেজ ভিড় করে সোশ্যাল মিডিয়া মেসেজিং অ্যাপগুলোয়, তার মধ্যে অন্য কিছু থাক বা না থাক, বাবা-মায়ের পাঠানো একটা ‘গুড মর্নিং’ মেসেজ থাকবেই! ব্যাকগ্রাউন্ডে গোলাপ অথবা টিউলিপের ছবি, সঙ্গে হয়তো দু’লাইনের হিন্দি শায়রি। এসব না হলে হয়তো লম্বা একখানা টেক্সট মেসেজ! কমবয়সী টেক-স্যাভি ছেলেমেয়েরা যাকে ব্যঙ্গ করে ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি’ বলে থাকে, তেমন কোনও সূত্র থেকে পাওয়া কিম্ভূতকিমাকার তথ্য ভরা কোনও মেসেজ। সেই মেসেজে হয়তো লেখা থাকে কাটা ফলের ভিতর দেবদেবীর মুখ দেখতে পাওয়ার কথা, অথবা স্রেফ লেবু-জল খেয়ে মানসিক অবসাদ কাটানোর ফন্দিফিকির! অগাধ বিশ্বাস নিয়ে এমনধারা মেসেজ সন্তানকে প্রায়শই ফরওয়ার্ড করে থাকেন বাবা-মা। যা দেখে মিলেনিয়াল অথবা জেন-জি সন্তানটি বিরক্ত হয়। নয় সে মেসেজ এড়িয়ে যায়, নয়তো বা ভুয়ো কথায় বিশ্বাস করবার অপরাধে রীতিমত কাঠগড়ায় দাঁড় করায় বৃদ্ধ অভিভাবকটিকে। সমীক্ষা কিন্তু বলছে, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মানুষদের যে আসক্তি, তার মুখ্য কারণ তার সন্তানই!
এক সময় পর্যন্ত কেবল পড়াশুনো বা চাকরির জন্যই বাড়ির থেকে, বাবা-মায়ের থেকে দূরে যেতে দেখা যেত সন্তানেরা। অথবা পূর্ণবয়স্ক হয়ে বিয়ের পর বাবার বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে থাকত। কিন্তু দৃশ্যপটে বদল এল ২০১০ নাগাদ, যখন ধীরে ধীরে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো জায়গা করে নিতে শুরু করল সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। ঘরে বসেই পুরনো বন্ধুর হদিশ পেল মানুষ, কখনও বা বহুদূরে থাকা কোনও মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাল। বিশ্বসংসার ধরা দিল তার হাতের মুঠোয়। ভিনরাজ্যের খাবার হোক বা ভিনদেশের রাজনীতি, সবটাই এসে হাজির হল নাগালের মধ্যে। আর বাবা-মায়েরা দেখলেন, কীভাবে এক বাড়িতে বা এক ঘরে থেকেও বহুদূরে সরে গেল তার সন্তান!
যোগ্যতম না হতে পারলে যে সমাজই তাকে বহিষ্কার করে দিতে চায়, ইতিহাসই সে সাক্ষ্য দিয়েছে বারবার। যে প্রজন্মের মানুষেরা চল্লিশের গণ্ডি পেরিয়ে তাই বার্ধক্যের দিকে ক্রমশ এগোচ্ছিলেন, অনেকখানিই ব্রাত্য হয়ে পড়লেন প্রযুক্তিময় ঝকঝকে নতুন সামাজিক প্রেক্ষাপটে। সন্তান যে তৎপরতার সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার খুঁটিনাটি আয়ত্ত করে, অভিভাবকের তা শিখতে অনেক সময় লেগে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে যে খবর বহুদিন আগেই জেনেছে সন্তান, অভিভাবকের জীবনে তা হাজির হয় আনকোরা চমকের মতো। তাছাড়া ভুয়ো খবরের রমরমা তো রয়েছেই। যেসব খবর সত্যি কিনা তা বুঝতে জেন-জি ছেলেমেয়েদেরই কালঘাম ছুটে যায়, স্বাভাবিকভাবেই বাবা-মায়েদের পক্ষেও তার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয় না। হয়তো সন্তানকে সেসব পাঠিয়ে আরওই বেশি হাসির পাত্র হয়ে পড়েন।
সমীক্ষা জানাচ্ছে, চল্লিশোর্ধ মানুষেরাই নাকি সবচাইতে বেশি মেসেজ ‘শেয়ার’ অথবা ‘ফরওয়ার্ড’ করে থাকেন। কখনও পরিচিতদের, আর বেশিরভাগটাই সন্তানকে। কেবল পাঠিয়ে দিয়েই শান্তি মেলে না, সন্তান সামনে এলে বারংবার প্রশ্ন করতে থাকেন তাঁরা, পাঠানো মেসেজ বা ভিডিওটি কি সে দেখেছে সারাদিনে? খাবার টেবিলে মায়েরা যেমন জোর করেই একটা রুটি বেশি দিয়ে যান, বা বাড়ি ফিরতে দেরী হলে বারবার খোঁজ নেন বাবা, এ-ও কিছুটা তেমনই। আদতে অমূলক, তবু সন্তানের ভালোটুকু ভেবেই করা। যেভাবে ছোটবেলায় কাজল পেন্সিল দিয়ে গোঁফ এঁকে বাবার মতো হতে চাইত খুদেরা, কিংবা মাথায় ওড়নার ঘোমটা দিয়ে মাকে খুঁজে পেত নিজের মধ্যে, সেভাবেই জোর করে প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত হতে চাইছেন বাবা-মা। অন্তত তাতে যদি সন্তান তাঁকে সমকক্ষ মনে করে!
হয়তো বাস্তবিকই রোজ সকালে উঠে এক গ্লাস আদা-জল খেলে মাইগ্রেন কমে যায় না। হয়তো সত্যিই নাসা-র বিজ্ঞানীরা বাংলাকে শ্রেষ্ঠ ভাষার তকমা দেননি। কিন্তু সন্তানকে সে ভুয়ো খবর পাঠানোর পিছনে রয়েছেন কোনও উৎসুক বাবা কিংবা মা। দুরুদুরু বুকে ভাবছেন, ঠিক কতটা ‘আপডেটেড’ থাকলে সন্তান গণ্য করবে তাঁকে?