বাক্ অর্থাৎ কথার অধীশ্বরী তিনি। তিনি বিদ্যার দেবী। কাব্য-ছন্দ-সাহিত্যও তাঁরই অধিগত। এক কথায় সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর একচ্ছত্র অধিষ্ঠান। কিন্তু, এই সৃষ্টি কি কেবল শব্দের জমিতেই? নাকি ধুলোমাটির পৃথিবীতেও একভাবে অধিকার রয়েছে দেবী সরস্বতীর? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
সরস্বতী শব্দের ব্যুৎপত্তি জানায়, যা সরস অর্থাৎ জল ধারণ করে, তাই সরস্বতী। কিন্তু যিনি বাক্দেবী, তাঁর নামের সঙ্গে তো এই সূত্রটির কোনও যোগ নেই আপাত দৃষ্টিতে। সত্যিই কি তাই? ঋক্মন্ত্র উচ্চারণ করে ঋষি গৃত্সমদ বলেছেন, ‘অম্বিতমে নদীতমে দেবিতমে সরস্বতি।’ অর্থাৎ সরস্বতীকে একইসঙ্গে শ্রেষ্ঠ নদী এবং দেবীশ্রেষ্ঠা রূপেও সম্বোধন জানিয়েছে সবচেয়ে প্রাচীন বেদ ঋগ্বেদ। ঋগ্বেদেই পাওয়া যায় এক নদীদেবতার কথাও, যাঁর নাম সরস্বান। তবে কি এই শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবেই সরস্বতীর উৎপত্তি? সরস্বতী কি আসলে এক নদী?
আরও শুনুন: সরস্বতী পুজো করার দাবিতে আন্দোলন কলেজের ছাত্রদের, মতান্তরে জড়ালেন রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র
ভারতবর্ষের ভৌগোলিক ইতিহাস বলে, উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রবাহিত হয় সরস্বতী নামে এক বিশাল নদী। হিমালয়ের সিমুর পর্বতের প্লক্ষ প্রস্রবণ এই নদীর উৎস। সপ্তসিন্ধুর অন্যতম বলেও গণ্য করা হয় এই নদীকে। যেহেতু নদীর তীরেই কোনও বড় সভ্যতা গড়ে ওঠে, এবং বৈদিক সভ্যতাও তার ব্যতিক্রম নয়, তাই এমন কথাও মনে করা হয় যে, আসলে এই সরস্বতী নদীর দুই তীরেই গড়ে উঠেছিল বৈদিক সভ্যতা। এই নদীর দুই তীরে বৈদিক সভ্যতার প্রধান প্রধান তীর্থক্ষেত্র গড়ে ওঠা এই মতকে আরও জোরালো করেছে। এই নদীর তীরেই বৈদিক সারস্বত যজ্ঞ হত বলেও জানা যায় প্রাচীন গ্রন্থে। তর্পণের জন্যও প্রশস্ত ছিল সরস্বতী নদী।
আরও শুনুন: SPECIAL PODCAST: উড়ো চিঠির হাতছানি আর স্মৃতির কোলাজে ডুব, বাঙালির বাণীবন্দনা
জলের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রেই ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কেবল সৃষ্টি নয়, কর্ষণের দেবী হিসেবেও একসময় পূজিতা হয়েছেন দেবী সরস্বতী। আসলে সরস্বতী নদীর দরুনই এর দুই তীরের সমভূমি ছিল অতি উর্বর। আর যা অন্ন দেয়, তাকে পূজা করার চল ভারতবর্ষে ছিল প্রাচীন কাল থেকেই। এমনকি ভাল ফসল পাওয়ার আশায় যে ব্রত করতেন সেকালের কৃষকরমণীরা, তাকেও ‘সারস্বত ব্রত’ নামেই চিহ্নিত করা হয়েছে। কালক্রমে এই উর্বর ভূমিতেই বিকশিত হল বৈদিক সভ্যতা। রচিত হল বৈদিক সাহিত্য। যার সূচনা ও সমাপ্তিতে থাকত সরস্বতীর বন্দনা। আর এইভাবেই নদীদেবতা হয়ে উঠলেন বিদ্যারও দেবী, ‘বাক হি সরস্বতী’। স্মৃতির আড়ালেই চলে গেল তাঁর কৃষিদেবীর রূপটি।