চলতি হিসেবে আমাদের চোখ যা দেখতে অভ্যস্ত, তার বাইরে কিছু ঘটলেই তাকে আমরা দাগিয়ে দিই অন্য বা অপর বলে। ফ্যাশন দুনিয়ার নিখুঁত পরিপাটি জগতে এই অন্যরকমদের ঠাঁই হওয়া যে সহজ ছিল না, সে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সেই কঠিন কাজটাই সেরে ফেলেছেন এমন অন্যরকম কিছু মানুষ, অঙ্গসংস্থাপনের নিরিখে যাঁদের অপর বলা চলে। এক কথায় তাঁরা বিশেষভাবে সক্ষম। ঠিক কী করেছেন তাঁরা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
শরীরচর্চা না করে উপায় নেই, কিন্তু কিছুতেই আর সেই আগ্রহ পাচ্ছেন না। তাই নিজেকে ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। ভাবলেন আগে শরীরচর্চার পোশাকআশাক কিনে ফেলা যাক, তাতে মন উৎসাহ পাবে। কিন্তু ই-কমার্স সাইট খুলে, সেই পোশাক দেখতে গিয়েই এল চমক। দেখতে পেলেন সেই পোশাকের বিজ্ঞাপনে রয়েছেন এমন এক মডেল, যিনি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। একজন মানুষ, নিজের সব প্রতিবন্ধকতাকে হেলায় কাটিয়ে যিনি এই প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁর উদ্যম নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলার থাকে? আর ভাবুন তো, এই জোরের সামনে নিজের আলস্যকেও কি আর গুরুত্ব দেওয়া চলে?
আরও শুনুন:
সন্তানে অনীহা, পোষ্যেই অপত্যসুখের বিকল্প! বাড়ছে ‘DINK’ দম্পতির সংখ্যা
হ্যাঁ, সত্যিই কিন্তু এমনটা করেছে এক সংস্থা। বা বলা ভালো, এমনটা করেছেন কোনও কোনও মানুষ। যারা আমাদের চলতি ছকগুলোকে ভেঙে দিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, অপরত্ব আসলে কোনও গণ্ডি টেনে দিতে পারে না। যে ফ্যাশন দুনিয়া শারীরিকভাবে নিখুঁত হওয়াকে প্রচণ্ড গুরুত্ব দেয়, সেই জগতেই তাঁরা ঢুকে পড়েছেন, অধিকার কায়েম করেছেন নিজেদের। যেমন ধরুন, এমি মালিন্স (Aimee Mullins)। বিশ্বের প্রথম বিশেষভাবে সক্ষম মডেল তিনিই। বিরল রোগে, দুটি পা-ই হাঁটু থেকে বাদ দিতে হয়েছিল। দুটি প্রস্থেটিক পা নিয়ে তিনি কখনও র্যাম্প মাতিয়েছেন তো কখনও প্যারালিম্পিকে লং-জাম্প দিয়েছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের মুখ হয়েছেন আবার অভিনয় জগতেও কাজ করে চলেছেন। এমনই আরেকজন মডেল ভিক্টোরিয়া মডেস্টা। অপরিণত পা নিয়েই মডেলিং শুরু করেছিলেন। ২০ বছর বয়সে সেটা হাঁটু থেকে বাদ দিয়ে প্রস্থেটিক পা নিয়ে কাজ শুরু করেন। নিজের গানে পারফর্ম করতে তিনি যখন মঞ্চে ওঠেন তখন তাঁর হাল ফ্যাশনের প্রস্থেটিক পা-ও, নজর কাড়ে দর্শকদের। বিশেষভাবে সক্ষম মডেলদের তালিকায় প্রথমদিকেই নাম রয়েছে শাহালি এয়ারস-এরও (Shaholly Ayers), ডান হাতের কনুই থেকে বাকিটা প্রস্থেটিক হাত নিয়েই যাকে পরপর ছবার, আন্তর্জাতিক ফ্যাশন উদযাপনের কেন্দ্র নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকে, মডেল হিসাবে দেখা গিয়েছে।
আরও শুনুন:
শরীর সুস্থ রাখা নাকি ব্যক্তিগত তথ্য চুরি, স্মার্ট ওয়াচ আদতে ‘উপকারী’?
২০১৬ সালেই, মূলত প্যারালিম্পিয়ানদের জন্য এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষদের শরীরচর্চা, খেলাধুলা বিষয়ে উৎসাহ দিতে, একটা বিশেষ দর্শন প্রচার করে বিখ্যাত জার্মান সংস্থা। যেটার পোশাকি নাম ছিল, ‘Odds by Adidas’। এই Odd শব্দটার মাধ্যমে যেমন খাপছাড়া বা অসাধারণ বোঝায়, তেমন বিষম বা বিজোড় সংখ্যাও বোঝায়। জোড়ের বদলে বিজোড় সংখ্যার অঙ্গের সাহায্যেই, জীবন অভ্যস্ত হতে বাধ্য করেছে যাদেরকে, তাঁদের প্রায় ৪% মানুষকে আমরা নানা বিজ্ঞাপনে দেখতে পাই। সংখ্যাটা উল্লেখযোগ্যভাবেই কম। তার একটা কারণ হয়তো এখনও একে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারার মতো পরিণত হয়ে উঠতে পারিনি আমরা। ওই যে, আমাদের কাছে ‘নর্মাল’ শব্দটার একটা ছক বাঁধা আছে যে। আর সেখানেই এসে দাঁড়াচ্ছেন এই মানুষেরা। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশই এই অন্যরকম, অপর মানুষেরা। আর তাঁদের অ-সাধারণত্বে আমাদের চোখকে সইয়ে দিতে নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছেন তাঁরা। নিজেদের শারীরিক গঠনগত অপূর্ণতাকে এঁরা যেভাবে উদযাপন করে চলেছেন, তাতে ‘নর্মাল’ শব্দের গণ্ডিটা যে দিনে দিনে আরও প্রসারিত হবে, এমন আশা তো করাই যায়।