একটা গোটা বিমান জুড়ে বসে আছে সারি সারি কঙ্কাল! এ-ও কি কখনও সম্ভব? আর পাইলট? যিনি চালিয়ে নামালেন বিমানটিকে? তিনি! তিনিও কি…! আশ্চর্য এক বিমানরহস্য। শোনাচ্ছেন, চৈতালী বক্সী। আবহ নির্মাণে শঙ্খ বিশ্বাস।
বারোই অক্টোবর, ১৯৮৯। সকালের আলো ফুটেছে ব্রাজিলের পোর্তো এলেগ্রো বিমানবন্দরে। চারিদিকে ব্যস্ততার চেনা ছবি। কর্মীরা গুছিয়ে নিচ্ছেন নিজের কাজ। পাইলটরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন আগামী উড়ানের। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের কর্মীরা বুঝে নিচ্ছেন সব ঠিকঠাক আছে কিনা। একটা গোটা দিনের কাজ সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে, যা যা করার দরকার, তাতেই মগ্ন কর্মীরা।
এমন সময় আকাশে ভেসে উঠল একটি অচেনা বিমান। এখন তো এরকম কোনও বিমানের আসার খবর ছিল না! কর্মীরা একটু অবাকই হলেন। একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন প্রথমে। তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বিমানটির পাইলটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও বিমান থেকে কোনও সাড়া মিলল না।
অথচ রানওয়ের দিকে দিব্যি এগোচ্ছে বিমানটি। বিস্ময়ের পাশাপাশি এবার ছড়াল আতঙ্কও। কোনও সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে না তো! তড়িঘড়ি নিজেদের নিরাপত্তা আঁটোসাটো করে নিলেন তাঁরা। দেখতে দেখতে অচেনা বিমানটি তখন ছুঁয়ে ফেলেছে রানওয়ের মাটি। খুব সাবধানে কর্মীরা এগোলেন বিমানের দিকে। আর দরজা খুলতেই সকলে থ। খানিকক্ষণ কারোর মুখেই কোনও কথা সরল না। সরবে কী করে! নিজের চোখকেই যে তখন তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছেন না। একটা গোটা বিমান জুড়ে বসে আছে সারি সারি কঙ্কাল! এ-ও কি কখনও সম্ভব? আর পাইলট? যিনি চালিয়ে নামালেন বিমানটিকে? তিনি! তিনিও কি…! কর্মীরা দৌড়লেন কেবিনের দিকে। আর তাঁদের বিস্ময়কে শতগুণ বাড়িয়ে যে দৃশ্য ধরা দিল, তা যেন হার মানায় গল্পকেও। হ্যাঁ, ককপিটে আর কেউ নয়, বসে আছে পাইলটের কঙ্কাল। কঙ্কাল বোঝাই এক বিমানকে মাটিতে নামিয়েছে ক্যাপ্টেন কঙ্কাল। ঘটনার অভিঘাতে তখন গোটা বিমানবন্দর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে অদ্ভুত ভয়-ধরানো নীরবতা।
প্রাথমিক হকচকানি কাটতেই, এয়ারপোর্টের পুরনো কর্মীরা অবশ্য চিনতে পারলেন বিমানটিকে। এ যে ফ্লাইট সানতিয়েগো ৫১৩! অবিশ্বাস্য! এ তো আজকের বিমান নয়। সেই পঁয়ত্রিশ বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল এই বিমান। রহস্যজনক অন্তর্ধানের পর আর কোনও হদিশ মেলেনি। প্রায় সাড়ে তিন দশকের মাথায়, ৮৮ জন যাত্রী আর চারজন বিমানকর্মী, মোট ৯২টি কঙ্কাল নিয়ে ফিরে এসেছে সেটি।
কিন্তু সত্যি সত্যিই কি এই ঘটনা ঘটা সম্ভব? কোথায় ছিল এতদিন বিমানটি? কীভাবেই বা ফিরে এল এতদিন পর? কীভাবেই বা ক্যাপ্টেনের কঙ্কাল নিখুঁতভাবে নামাল বিমানটিকে? অনেকগুলো অমীমাংসিত প্রশ্ন সঙ্গী করে, এয়ারপোর্টে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, ফ্লাইট সানতিয়েগো ৫১৩।
(ট্রানজিশন)
এই রহস্যের ভিতর আলোর খোঁজে আমাদের ওলটাতে হবে একটি ট্যাবলয়েডের পাতা। চোদ্দই নভেম্বর, ১৯৮৯-এ, ‘দ্য উইকলি ওয়ার্ল্ড নিউজ’ নামের এই ট্যাবলয়েডের পাতাতেই বেরিয়েছিল বিমান ফিরে আসার খবরটি। সেখানে লেখা – ১৯৫৪ সালের চৌঠা সেপ্টেম্বর নিখোঁজ হয়েছিল বিমানটি। ব্রাজিলের অ্যাভিয়েশন অথোরিটি-র তথ্য অনুযায়ী, বিমান সানতিয়েগো ৫১৩-র যাত্রা শুরু করেছিল তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি থেকে ব্রাজিলের উদ্দেশে। বিমানে যাত্রী এবং বিমানকর্মী মিলিয়ে ছিলেন বিরানবব্বই জন। যাত্রা ছিল মোট আঠেরো ঘণ্টার। কিন্তু মধ্যিখানে আটলান্টিক মাহসাগরে কোনও এক অজ্ঞাত স্থানে, অজানা কোনও কারণে, উধাও হয়ে যায় বিমানটি। কয়েকদিন ধরে চলে বিস্তর খোঁজাখুঁজি। তারপর অনুসন্ধাকারী দল সিদ্ধান্তে আসেন, বিমান আটলান্টিক সাগরের কোথাও একটা দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। সেখানেই ধ্বংস হয়েছে সেটি। সমস্ত যাত্রীরই বোধহয় হয়েছে সলিল সমাধি।
ট্যাবলয়েডে প্রকাশিত খবরে এইসব তথ্যই পাওয়া যায়।
কিন্তু তারপরেও থেকে যায় কিছু প্রশ্ন। একটা বিমান কি সত্যিই ৩৫ বছর পর কঙ্কাল নিয়ে ফিরে আসতে পারে! আবার তার ককপিঠে বসে কঙ্কাল পাইলট! এমনটা আদৌ বাস্তবসম্মত! ট্যাবলয়েডটির কুষ্ঠি-ঠিকুজি এবার যদি একটু ঘাঁটা যায়, তবে রহস্য খানিক কাটে। অনেকেই বলে থাকেন, ট্যাবলয়েডটি নাকি আষাঢ়ে গপ্পো বানাতে ছিল ওস্তাদ। এটিও নাকি সেরকমই একটি গপ্পোকথা। এই খবর প্রকাশের চার বছর আগে ‘প্যান অ্যাম ফ্লাইট ৯১৪’ নামের একটি বিমান হারিয়ে গিয়েছিল। সেই বিমানকে খুঁজে পাওয়া যায়নি প্রায় সাঁইত্রিশ বছর। পরে একদিন সেটি আচমকাই ফিরে আসে, এবং অক্ষত অবস্থায় তার অবতরণ হয়। যদিও সেখানে কোনও কঙ্কাল ফেরেনি। সেই ঘটনাকে এই গপ্পের সঙ্গে কেটে জুড়ে একটা মুখরোচক গপ্পো বানিয়েছিলেন ট্যাবলয়েডের লেখক আরউইন ফিশার। লাভের লাভ বলতে রাতারাতি এই ট্যাবলয়েডের বিক্রি হয়েছিল আকাশ-ছোঁয়া।
১৯৬১-র একটি টিভি শো ‘দ্য টোয়ালাইট জোন’-এ একটি এপিসোড সম্প্রচারিত হয়েছিল। সেটির নাম ছিল, ‘দ্য ওডিসি অফ ফ্লাইট ৩৩’, সেখানেও একটি বিমান হারিয়ে যাওয়ার গপ্পো ছিল। তারপর সেও অনেকদিন পর, কোথাও থেকে একটা কোনওভাবে ফিরে আসে। লেখক গপ্প ফাঁদার দ্বিতীয় উপাদান পেয়েছিলেন এখান থেকেই।
এই গপ্পো ডাহা ভুয়ো ধরে নেওয়ার আরও একটি বড় কারণ, ১৯৫৪ থেকে প্রকাশিত খবরে এরকম নামের কোনও ফ্লাইট হারিয়ে যাওয়ার কোনও খবর কোনও এয়ারপোর্ট থেকে পাওয়া যায়নি। সানতিয়েগো এয়ারলাইন্স তাঁদের ব্যবসা শুরু করেছিল ১৯৫৬ সাল নাগাদ। তাঁদের সবথেকে পুরনো কর্মচারীরাও এই বিমান বিষয়ে বিশেষ কিছুই জানাতে পারেননি। সুতরাং, এটাকে আজকের ভাষায় বলা যায় ‘ফেক নিউজ’ বা ‘হোক্স’।
তবে, এই যুক্তিতে অনেকেরই মন ভরেনি। তাই জোরকদমে চলেছে এই ঘটনার পিছনে যুক্তির খোঁজ। ড. সেলসো অ্যাটেলো নামে এক প্যারানর্মাল অ্যাক্টিভিস্ট জানান, আষাঢ়ে গপ্পো নয়, এমনটা সত্যিই সম্ভব। তিনি বলেন, বিমানটি ঢুকে পড়েছিল রহস্যজনক টাইম ব়্যাপ বা ভর্টেক্সে। ভর্টেক্স আদতে প্যারালাল ইউনিভার্স। কোনও চিহ্ন না রেখে বিমান, জাহাজ, মানুষ অনেককিছুই সেখানে হারিয়ে যেতে পারে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল, ডেভিলস সি জোন, মিশিগান ট্রায়াঙ্গল, সেই ধরনের টাইম ব়্যাপ তৈরি করে রেখেছে। এই বিমান উধাও হয়েছিল সে রকমই কোনও গোলকধাঁধায়। সে কারণেই পাক্কা পঁয়ত্রিশ বছর উধাও ছিল।
অনেকে আবার কল্পবিজ্ঞানের কিছু তত্ত্ব দিয়ে এই গল্পের সত্যতার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন।
কিন্তু সে নয় হল। কঙ্কাল ক্যাপ্টেন বিমানটিকে অবতরণ করালেন কী করে? সেই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য মেলে না।
ঘটনা যাই হোক, এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যত প্রশ্নই থাক না কেন, আজও মানুষকে একই ভাবে রোমাঞ্চিত করে এই বিমানের হারিয়ে যাওয়া, আর, কঙ্কাল নিয়ে তার ৩৫ বছর পর ফিরে আসার গল্প।
গল্প নাকি সত্যি? সে বিচারের ভার নাহয় আপনাদের উপরই থাকল।