কান পাতলেই শোনা যায় দেশ জুড়ে ধর্মীয় বিদ্বেষ, হানাহানির খবর। তবু তার ভিতরেই যেন লুকিয়ে রয়েছে অন্য একটা দেশ। যেখানে ধর্মের কথা মনে থাকে না কারও। সেই ভারতবর্ষকে পাহারা দেয় মানবিক সম্পর্কেরা। আর তেমনই ভারতের খোঁজ মিলল এবার বিহারে। যেখানে দু-দশকের সম্পর্কের কাছে হার মানল ধর্মীয় রীতি-প্রথা। ২৫ বছর ধরে দোকানে কাজ করা হিন্দু কর্মচারীর শেষকৃত্যে অংশ নিল মুসলিম পরিবার। নিয়ম মেনেই সম্পন্ন হল দাহকাজ। আসুন, শুনে নিই সেই অন্য ভারতের গল্পখানা।
পাটনা শহরের রাজাবাজার এলাকায় ছোটখাটো একটি কাপড়ের দোকান। সেই দোকানে দু-দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন রামদেও শাহ নামে এক হিন্দু ব্যক্তি। রিজওয়ানের দোকানে পঁচিশ বছর আগে কাজের আশায় এসেছিলেন রামদেও। কাজ পেতে মরিয়া রামদেও তার আগে কত দোকানে দোকানে ঘুরেছেন। খেয়েছেন ঠোক্করও। পেটে তখন আগুন জ্বলছে। সেই অবস্থায় একদিন রিজওয়ানের কাছে এসে পৌঁছন রামদেও। তাঁর সব কথা শোনার পরে একমুহূর্তও দেরি করেননি রিজওয়ান। তাড়াতাড়ি দু’টো খেতে দেন রামদেওকে। তারপর ওই কাপড়ের দোকানেই কাজ জুটে যায় তাঁর। হিসেব সামলানোর কাজ। তার পর কেটে গিয়েছে পঁচিশটা বছর, কবে যেন রিজওয়ানদের পরিবারেরই পরিজন হয়ে উঠেছিলেন রামদেও।
আরও শুনুন: ৬০ বছর ধরে তীর্থযাত্রীদের করিয়েছেন অমরনাথ দর্শন, এখনও মন্ত্রপাঠ করেন বৃদ্ধ গুলাম নবি
সম্প্রতি বয়সের কারণে মৃত্যু হয় তাঁর। চিকিৎসা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। তবে বাঁচানো যায়নি ৭৫ বছরের রামদেওকে। মৃত্যুর আগে রিজওয়ানের বংশধর মহম্মদ আরমানের কাছে শেষ ইচ্ছেটুকু জানিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। একদিন কথায় কথায় জানিয়েছিলেন, তাঁর সন্তান বা পরিবার বলতে তো কিছুই নেই। আরমানই তাঁর সন্তানসম। তাই শেষকৃত্যের ভারটুকু তাঁর কাঁধেই দিয়ে গিয়েছিলেন বৃদ্ধ রামদেও। আর সেই ইচ্ছাপূরণে এতটুকু কসুর করেননি আরমান ও তাঁর পরিজনরা। হিন্দু মতেই শেষকৃত্যের সমস্ত আয়োজন করা হয়। এমনকী তাঁকে কাঁধে করে শ্মশানেও নিয়ে গিয়েছেন আরমানরাই। পঞ্চভূতে বিলীন হয়েছে রামদেওয়ের দেহ। না, সেই কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি ধর্মের প্রভেদ।
আরও শুনুন: নিরন্নের মুখে খাবার তুলে দেওয়াই ধর্ম! ইউটিউব চ্যানেল খুলেই সেই কাজই করে চলেছেন তিন বন্ধু
দিন কয়েক আগেই হজরত মহম্মদকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন বহিষ্কৃত বিজেপির নেত্রী নূপুর শর্মা। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশ জুড়ে জায়গায় জায়গায় ছড়ায় হিংসা। এমনকী ওই ঘটনার জেরে ভয়াবহ একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে গিয়েছে রাজস্থানের উদয়পুরে-ও। এত সব হিংসা, বিদ্বেষ-বিষের মধ্যে বোধহয় আশার কথাই শোনায় আরমান-রামদেওদের এই মানবিক সম্পর্ক। আসলে এটাই তো সেই চেনা দেশ। যেখানে যুগ যুগ ধরে মিলেমিশে থেকেছে বহু ভাষা, বহু মত, বহু ধর্মের মানুষ। বিপদে আপদে পাশে দাঁড়িয়েছে। আর মৈত্রীর সেই একখণ্ড ভূমিই যে ভারতবর্ষ, আকালের দিনে এই ভাবনা বোধহয় বেশ খানিকটা ভরসা-ই জোগায়।