দোল মানেই বাতাসে মিশে যায় আবিরের রং। সেই রঙের নেশা ভুলিয়ে দেয় বয়স-শ্রেণি-জাতের বেড়াজাল। মানুষের সঙ্গে জুড়ে দেয় অন্য মানুষকে। দোল কেবল রাধাকৃষ্ণের মিলনের কথাই বলে না, আসলে সেই গল্পের আড়ালে বয়ে চলে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলেমিশে যাওয়ার গল্প। আর যুগে যুগে কালে কালে সেই গল্পেরই সাক্ষী থেকেছে ভারতবর্ষ। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
হোলি উপলক্ষ্যে সেজে উঠেছে প্রাসাদ। বাতাসে উড়ছে আবির গুলাল, ভাঙ-শরবতের ফোয়ারা ছুটছে, আর উৎসবের আবহ হয়ে ভেসে আসছে গীত বাদ্য নৃত্যের মিলিত ধ্বনি। হঠাৎ দেখা গেল মঞ্চে উঠে এসেছে এক নতুন নর্তকী। খানিক পৃথুলা চেহারা তার, বুঝি বা বয়সের ছাপও দেখা যায় শরীরে। কিন্তু উৎসাহ আর দক্ষতা, কোথাও কোনও কমতি নেই তার। যেমন নাচের ভঙ্গি, তেমনই তার গানের গলা। ঠুমরির সুরে ভরে উঠেছে চতুর্দিক। কে এই নর্তকী? ভাল করে তাকিয়ে দেখতেই চমকে উঠলেন উপস্থিত অতিথি অভ্যাগতরা। কোনও সাধারণ নর্তকী নয়, মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করছেন স্বয়ং নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ!
আরও শুনুন: রং খেলবেন, কিন্তু রঙের হাত থেকে মোবাইল ফোনটিকে বাঁচাবেন কীভাবে?
একে ধর্মে মুসলমান, তায় নবাব। কিন্তু এমনভাবেই হোরিখেলায় মেতে উঠতেন শিল্পরসিক নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। হোলি যে তাঁর কাছে সম্প্রীতির উৎসব। সেইজন্যেই নিজের রাজ্যে ধুমধামে হোলিখেলার প্রচলন করেছিলেন নবাব। আর তাতে সামিল হতেন তিনি নিজেও। এমনকি একবার মহরম আর হোলি একই দিনে পড়ে যাওয়ায় রাজ্যের হিন্দুরা হোলিখেলা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যেহেতু ইসলাম ধর্মে রংকে হারাম মনে করা হয়, সেইজন্য। কিন্তু এ কথা শুনে উভয় ধর্মের প্রতিনিধিদের ডেকে নবাব জানিয়েছিলেন, দুই ধর্মের অনুষ্ঠানই পালন করা হবে একইরকম মর্যাদার সঙ্গে।
আরও শুনুন: ত্বকের যত্ন নিন… রঙের উৎসবে মেতে ওঠার আগে ঠিক কী করবেন? রইল টিপস
দোল আসলে প্রেমের দিন, মিলনের দিন। জাতি-ধর্মের সংকীর্ণ গণ্ডির ঊর্ধ্বে উঠে সেই উৎসবকে তাই মিলনোৎসব বলেই দেখতে চেয়েছেন শুভবোধসম্পন্ন মানুষেরা। যে রং মানুষকে মিলিয়ে দেয়, তাদের সম্মিলিত করে, সেখানে পাপ কীসের, এমন প্রশ্নও তুলেছেন ইসলাম ধর্মের সাধক কবিরা। নিজামুদ্দিন আউলিয়া, বুল্লে শাহ, আমীর খসরু— অনেকের লেখাতেই ছড়িয়ে গিয়েছে হোরিখেলার রং। আর কেবল সুফি সাধকেরা নন, এই উৎসব থেকে সরে থাকেননি বিজাতীয় শাসকেরাও। নতুন দেশে এসে সেই দেশের মানুষকে চিনতে চিনতে, তাদের সংস্কৃতিকেও আপন করে নিয়েছিলেন অনেক মুসলমান নবাব। রুক্ষ দেশ থেকে এদেশে এসে হোলির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর। আর আকবরের আমল থেকে মুঘল রাজপরিবারও অংশ নিতে শুরু করল এই উৎসবে। পরবর্তী সম্রাট জাহাঙ্গিরের জীবনী ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরি’-তেও মেলে জাহাঙ্গির আর নূরজাহানের রঙের খেলায় মেতে ওঠার বর্ণনা। আর শাহজাহানের আমলে তো হোলির নতুন নাম হল, ‘ঈদ-ই-গুলাবি’ আর ‘জশন-ই-আব-পাশি’। জাতের বেড়া ঠেলে মিলনের উৎসব হয়ে উঠল হোরিখেলা। এমনকি পরবর্তী কালে উর্দু কবিতায় তৈরি হয় ‘হোরি’ নামের একটি নতুন ধারা। রাধাকৃষ্ণের অনুষঙ্গ থেকে চৈতন্যদেব মিশে আছেন যে উৎসবে, সেই উৎসবই আবার হয়ে উঠেছে নবাব অর্থাৎ মুসলমান শাসকদেরও। হোলি তাই নেহাতই রং মাখার উৎসব নয়। বরং বিভাজনের রং মুছে ফেলে সম্প্রীতির আবিরে রেঙে ওঠারই লগ্ন।