রামনবমীর পতাকা বানাচ্ছেন বৃদ্ধ। সেই নিয়ে চর্চায় বুঁদ সোশাল মিডিয়া। কারণ, ওই বৃদ্ধ ধর্মে মুসলিম। পেশার তাগিদেই হয়তো এই কাজ তিনি করছেন। তাও এর মধ্যেই সম্প্রীতির যাবতীয় বার্তা খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে।
ভরা বৈশাখ। ঠা ঠা রোদ। গরমে বাইরে টেকা দায়। ঘরেও যে শান্তি আছে এমন নয়। দরদর করে ঘামতে ঘামতে সেলাই মেশিন চালাচ্ছেন এক বৃদ্ধ। হাতের জাদুতে বুনছেন পতাকা। উপরে রামের ছবি, কোনওটায় হনুমানের। একটার পর একটা পতাকা তৈরি হচ্ছে। ক্লান্তি, গরম, ঘাম, সব আছে, তবু হাত থামছে না।
এমনই এক গরমের দিনে মাথায় ইটের বোঝা নিয়ে উপরে উঠছেন এক প্রৌঢ়। সেখানে আরও কয়েকজন রয়েছে। কিছু একটা তৈরি করছেন এঁরা। একপাশে শিবলিঙ্গ রাখা আছে। আকারে বেশ বড়। বোঝাই যায়, যা তৈরি হচ্ছে সেটা কোনও মন্দিরের অন্দরমহল, সেখানে শিবলিঙ্গ স্থাপনের প্রস্তুতি চলছে।
কিংবা কোনও শীতের দিনে একমনে মূর্তির চোখ আঁকছেন কেউ। তৈরি হচ্ছে ছোট বড় নানা মাপের সরস্বতী। কিছুদিনের মধ্যেই মূর্তিগুলি বিভিন্ন মন্ডপের উদ্দেশে রওনা দেবে। তার আগে তড়িঘড়ি কাজ সেরে ফেলতে হবে। রাত বাড়ছে, সেই সঙ্গে ঠান্ডাও। তবু থামছে না হাত।
তিনটে ঘটনাই কাল্পনিক। আলাদা করে এই নিয়ে চর্চারও কিছু নেই। কুমোরটুলি, বড়বাজার কিংবা কলকাতার যে কোনও প্রান্তে এমন দৃশ্যের জন্ম হতে পারে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এমন হাজার হাজার ঘটনা তৈরি হতে পারে। কিন্তু এই নিয়ে আলোচনা হবে তখনই, যখন ওই কাজে ব্যস্ত ব্যক্তিটির পদবী সামনে আসবে। হিন্দু হলে, সমস্যা নেই। মুসলিম হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু কোনও মুসলিম রামের ছবি দেওয়া পতাকা তৈরি করছেন, কিংবা শিবলিঙ্গ বসানোর কাজ করছেন, কিংবা সরস্বতী মূর্তির চোখ আঁকছেন, এমনটা বেশ অস্বাভাবিক মনে হবে অনেকের কাছে। কেউ কেউ বিষয়টা বাঁকা চোখে দেখবেন। কেউ কেউ সম্প্রীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলে দাগিয়ে দেবেন। কেউ আবার ফলাহ করে খবর ছাপবেন, যেন ভীষণ অন্যরকম কোনও চমৎকার হয়েছে। অথচ কেউ সাধারণ ভাবে দেখবেন না। ওই তিনজন বা ওদের মতো আরও অনেকে স্রেফ পেশার তাগিদে এমন কাজ করেছেন, এটাও কারও মনে আসবে না। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এমনটা যেন সত্যিই বড় অস্বাভাবিক। অথচ উলটোদিকে যারা এই কাজ করছেন, তারা কোনও বিশেষত্ব খুঁজে পান না এইসবে। আর পাঁচটা কাজের মতো হিন্দু দেবতার মূর্তি গড়া বা পতাকা তৈরিকে দেখেন।
তাও নাহয় মানা গেল। ভিন ধর্মের কোনও কাজের সঙ্গে কেউ পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন, তাই সেখানে সম্প্রীতির গন্ধ এল। কিন্তু একই দাবি কোনও মুসলিম ভারতের পতাকা তৈরি করলেও, শোনা যায়। সেখানে এই তুলনার কি কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে? বিতর্কের বিষয়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে, যা এড়িয়ে যাওয়াই সমীচীন বলে মনে করেন অনেকে। আর সেই আবহে উঠে আসে আরও কিছু নতুন ঘটনা। ঠিক যেমন চর্চায় এসেছেন গিরিডির এক মুসলিম বৃদ্ধ। তাঁর একটি ছবি বেশ ভাইরাল হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি পতাকা সেলাই করছেন। যে সে পতাকা নয়, স্বয়ং হনুমানের ছবি দেওয়া পতাকা। আসন্ন রামনবমীতে এই ধরনের পতাকায় ছেয়ে যাবে দেশের অলি-গলি। তাই দম ফেলার সময় নেই বৃদ্ধের। শুধু তিনি একা নন, একইভাবে একই কাজ করছেন আরও অনেকে। তারাও অনেকে ধর্মে মুসলিম। কাজের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁরা অন্তত এমনটাই মনে করেন। আলাদা করে সম্প্রীতির বার্তা দিতে যে এমনটা করছেন তাও নয়। তবু মাথায় ফেজটুপি পরা মহম্মদ আখতার রামনবমীর পতাকা বানালে ভাইরাল হন। নতুন ভারতে হয়তো এমনটাই স্বাভাবিক।