নর্তকী আনারকলির প্রেমে পড়েছিলেন স্বয়ং নবাবজাদা সেলিম। তার পরিণতি যে কী হয়েছিল, তা সকলেরই জানা। কিন্তু সেলিম যখন জাহাঙ্গির নাম নিয়ে মসনদে বসলেন, তাঁর দরবারেও ঘটেছিল সেরকমই এক কাণ্ড। জানেন কি, প্রেমিক-প্রেমিকাকে সেদিন কী শাস্তি দিয়েছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গির? আসুন, শুনে নেওয়া যাক মুঘল দরবারের এক অজানা গল্প।
থমথম করছে গোটা দেওয়ান-ই-খাস। একটা ছোট্ট পিন পড়লেও বুঝি শব্দ শোনা যাবে তার। ভয়ে শুকিয়ে গিয়েছে অনেকেরই বুক। আজ আর রক্ষা নেই। সম্রাট হয় গর্দান নেবেন, নইলে কারাবাসের নিদান দেবেন নিশ্চিতভাবেই। কারও কারও ঠোঁটে অবশ্য বাঁকা হাসি, বড্ড বেড়েছিল সাহেবটা। ভিনদেশ, ভিন জাত, এদিকে বাদশার পেয়ারের লোক বলে ফুলেফেঁপে উঠেছিল একেবারে। সাধে বলে, ‘বড়র পিরিতি বালির বাঁধ/ ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণেকে চাঁদ’। ভিনজাতের কথাটা অবশ্য ঘুরপাক খাচ্ছে আরও অনেকের মনেই। মানুষটা যে সাগরপাড়ের এক সাহেব। সাহেব হয়ে মুসলমানের মেয়েকে বিয়ে করার কথা বলছেন তিনি! এমন স্পর্ধা কি মেনে নেবেন সম্রাট জাহাঙ্গির?
আরও শুনুন: কেবল শাহজাহান নন, প্রিয়জনের স্মৃতিসৌধ গড়েছিলেন ভারতের এই রানিরাও
ঠিক কী হয়েছিল সেদিন? খুলেই বলা যাক সে গল্প।
মুঘল দরবারে মনোরঞ্জনের জন্য হাজির থাকত নাচগানে পটু, অপূর্ব সুন্দরী অসংখ্য মেয়ে। পেশা অনুযায়ী কোনও দলের মেয়েদের বলা হত বাইজি, কোনও দলের মেয়েদের তকমা হল তবায়েফ। এই তবায়েফরা বাদশার অনুগ্রহ পেত, তবে হারেমে তাদের ঠাঁই হত না। এদিকে দরবারের খানদানি আমির-ওমরাহদের আমোদ-আহ্লাদের আসরেও ডাক পড়ত তাদের। ফেলে আসা জীবনে এরা ছিল দরিদ্র ভদ্র ঘরের মেয়ে। বারবনিতা নয়, তবে প্রকাশ্য সভায় নর্তকী হওয়া ছাড়া গতি ছিল না এই মেয়েদের। আর এমনই একজনের প্রেমে পড়েছিলেন বাদশার খাস ডাক্তার বার্নার্ড। হিন্দুস্থানে তখন টাকা ওড়ে। তায় বার্নার্ড সাহেব খোদ বাদশা, আর সেইসঙ্গে গোটা মুঘল হারেমের ইলাজের ভার সামলান। বাদশার সঙ্গে তাঁর ভারী খাতির। সুতরাং টাকাপয়সার লেখাজোকা নেই। মাঝে মাঝেই বাড়িতে নাচের আসর বসান সাহেব। আর এই নাচের আসরেই একদিন একজনকে এমন মনে ধরে গেল যে মনে হল এই মেয়েকে না পেলে তাঁর জীবনই বৃথা।
আরও শুনুন: তাঁর মৃতদেহের উপরে পড়ুক মানুষের পায়ের ছাপ, চেয়েছিলেন বাংলার এই নবাব
কিন্তু ভালবাসার মানুষটিকে পাওয়ার পথে একে তো ধর্মের কাঁটা। তার চেয়েও বড় কথা, তবায়েফদের নিয়ম রয়েছে, বিয়ে করতে পারবে না তারা। বেচারা প্রেমিক মনমরা হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। এমন সময় বেড়ালের ভাগ্যে বুঝি শিকে ছিঁড়ল। হারেমের এক বেগমকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন ডাক্তার সাহেব। আনন্দে আটখানা বাদশার ঢালাও প্রতিশ্রুতি, কী ইনাম চান ডাক্তার? সাহেব দেখলেন, এই তাঁর সুযোগ। অনেক মুসাবিদা করে বলেই ফেললেন কথাটা। আর কিছু নয়, ওই মেয়েটিকে বিয়ে করতে চান তিনি।
শুনে তো দরবারে হাজির সকলের আক্কেল গুড়ুম! এহেন দুঃসাহসী প্রস্তাব শুনে বাদশা কী ভয়ানক শাস্তি দেবেন, সেই চিন্তায় সবাই অস্থির। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ হেসে উঠলেন খোদ জাহাঙ্গির। জানালেন, শাস্তিই পেতে হবে বইকি তাঁর প্রিয় সভাসদকে। দরবার থেকে এই মেয়েটিকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে হবে সাহেবকে। আর এই শর্ত মানলে তবেই মুঘল পরম্পরার পুরনো নিয়ম ভেঙে তবায়েফের বিয়েতে রাজি হবেন বাদশা।
এর পরে যে মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়েছিল, সে কথা বলাই বাহুল্য। এক শাসকের দরবারে সব নিয়মকানুনের বেড়াজাল পেরিয়ে প্রেমের জয় হয়েছিল সেই দিন। দুই দেশের, দুই ধর্মের, দুই ভাষার, এমনকি সমাজের দুই পৃথক শ্রেণির দুজন মানুষকে মিলিয়ে দিতে পেরেছিল প্রেম।