কেউ মানুক, না-মানুক, কোকিল মানে না। তার ডানায় বসন্ত আসে, আজও সে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে, সুদিন আসবেই। একদিন না হোক, এক দিন ঠিক। আর তাই কেবলই ডেকে ডেকে মরে। এই শহরে। ইট-কাঠের জঙ্গলে, কোথায় যেন আত্মগোপনে। শহর তার ডাক শোনে। খেয়াল করে, ফুল ফুটুক না-ফুটুক আজ বসন্ত।
স্টেপ জাম্পের অঙ্ক কষছে প্রকৃতি। শীত থেকে সোজা গ্রীষ্মে। বসন্ত বিলকুল গায়েব। পলাশের থেকে লাশের খবরই বেশি চারিদিকে। শহরে ইতিউতি রুদ্রপলাশের দেখা মেলে বটে। তবে, কৃষ্ণচূড়ায় লাল নিশান ওড়ানো তেমন বসন্ত কই! নতুন কথা নয় অবশ্য। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই বসন্তের জন্য নিরুদ্দেশের উদ্দেশে ঘোষণা জারি করেছেন। মার্চের গরমের সঙ্গে ফ্যানের এমন আসন সমঝোতা যে, বসন্তের বাতাসের রীতিমতো জমানত জব্দ। তাহলে বসন্ত কি একেবারই নেই? আছে বলতে লুকনো এক কোকিলের ডাকে। বসন্ত আসুক না-আসুক সে বেচারি মুখে রক্ত তুলে ডেকেই চলেছে।
আরও শুনুন
বসন্ত উৎসব ঘিরে যত উন্মাদনা, শান্তিনিকেতনের জমিও কেনা হয়েছিল এই বসন্তে
কোকিলের ডাকেই বসন্তের আগমন। ফল, রেঙে-ওঠা বসুন্ধরা। গমন, চৈত্রের গাজনে। ফল, বছর-সমাপ্তি ও নূতন বছরে শুভারম্ভ। এই তো ছিল দস্তুর। গোল বাধিয়েছে হতচ্ছাড়া গ্লোবাল ওয়ার্মিং। বিশ্ব জুড়ে গরমের রেগুলেটর সে কয়েক ঘর করে বাড়িয়ে দিয়েছে। বছরের ক্যালেন্ডারে তাই মোটামুটি ঋতু একখানাই। শুধু লাল-দাগ হলিডে-তে সে ছুটি নিলে যেন অন্যান্য ঋতুরা একটু খেল দেখানোর সুযোগ পায়। বর্ষা খানিক নাছোড়বান্দা, জেদি প্রকৃতির। নাগাড়ে কয়েকদিন খাটাখাটনি করে তবেই বিদেয় নেয়। শরৎ তো স্বভাবলাজুক। গ্রীষ্মীয়-ফ্যাসিবাদে সে বুঝেই উঠতে পারে না, থাকলেও কোন চরিত্র নিয়ে থাকা উচিত। প্রকৃতি তার জন্য নির্দিষ্ট যে রূপ-রস-রং ধার্য করেছে, তা তো আর কোনওভাবেই ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অতএব দুর্গাপুজোর গায়ে গা লাগিয়ে কোনক্রমে মুখরক্ষা। মুখচোরা হেমন্ত অবশ্য সেটুকুও বজায় রাখতে পারেনি। ফ্ল্যাটবাড়ি উঠে যাওয়া পাড়ার একচিলতে ফাঁকা জায়গার মতো সে হারিয়ে গিয়েছে, চিরতরেই একরকম। শীত খানিক নলেন গুড়ে, খানিক সোয়েটারে, অনেকখানিই নস্ট্যালজিয়ায়। গ্রীষ্ম যেন ঋতুর পৃথিবীতে দক্ষিণপন্থা। এই মুহূর্তে বিশ্ব জুড়েই তার প্রবল দাপট। সে দাপটের সঙ্গে বসন্তেরই বা পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা কোথায়! বসন্ত তো স্বভাবে সন্ন্যাসী রাজা। রঙের, রূপের বিপুল ঐশ্বর্য তার সম্পদ। আবার নিজের যাবতীয় সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে ফকিরের মতো ফিরে যেতেও দ্বিধা নেই। এই খামখেয়াল পাগলবসন্তকেই নিয়েই হয়েছে সমস্যা। তাকে দেখতে না পেলে মনখারাপ। এদিকে গ্রীষ্মের মধ্যে এমন উদারতা অবশিষ্ট নেই যে, বসন্তের আবদার মেনে নেবে। জলহাওয়ার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গরমের এই আগ্রাসনে সব ঋতুরই ইশতেহার মলিন, বিবর্ণ। ভোটে গোহারান হারা দলের সর্বভারতীয় পার্টি অফিসের মতোই তাদের দরজা খোলা, তবে ওটুকুই। সে তালপুকুরও নেই, ঘটিও আর ডোবে না। কিন্তু, বসন্ত যে বসন্ত, যে কিনা রাজা আর বাউল, যে কিনা প্রকৃতির শিল্পরূপের শ্রেষ্ঠ প্রদর্শশালা, সে কি এমন অবমাননা মেনে নেবে!
আরও শুনুন
যে বসন্ত আসার কথা, সচরাচর আর আসে না
কেউ মানুক, না-মানুক, কোকিল মানে না। তার ডানায় বসন্ত আসে, আজও সে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে, সুদিন আসবেই। একদিন না হোক, এক দিন ঠিক। আর তাই কেবলই ডেকে ডেকে মরে। এই শহরে। ইট-কাঠের জঙ্গলে, কোথায় যেন আত্মগোপনে। শহর তার ডাক শোনে। খেয়াল করে, ফুল ফুটুক না-ফুটুক আজ বসন্ত। অন্যত্র কোকিল সংখ্যায় কমেছে। ভারতের কোকিলের এখনও সে-সংকট নেই। সংকটে বসন্ত স্বয়ং। তবু একান্ত অনুগত কোকিল এ প্রবঞ্চনা মানতে নারাজ। ক্লান্ত কর্মীর মতোই বসন্তের নিশান সে বয়ে নিয়ে চলেছে। যদি একজনও ডাক শুনে বসন্তকে অনুভব করতে পারে, তাই-ই সই। বসন্তের চেনা ছবি তাই আর ফোটে না বটে! তবে কোকিলের ঘড়িতে বসন্তের ছোট আর বড় কাঁটা এখনও বন্ধ হয়নি।
বসন্ত তবু ঋতু তো মাত্র নয়। নিজেই এক চরিত্র। যে সম্পদ বিলিয়ে দিতে জানে। উজাড় করে দিতে জানে নিজেকে। নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ায় তার অহংকার। অলংকার। আজ সে যেন পুরনো কোনও মানুষ। যার কথা শোনা যায়। গল্পও। আর জেগে থাকে শুধু আক্ষেপ- মানুষগুলো সব কোথায় গেল! প্রকৃতি বদলায়। সব অর্থেই। এই স্বার্থান্ধ সময়ে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মতো প্রকৃতির বড় একটা বেঁচে থাকার কথাও নয়। বসন্তেরও। হারিয়ে যাচ্ছে সে, হারিয়ে না গিয়ে উপায় কী! বসন্ত মেনে নিয়েছে, বেশিরভাগ মানুষও। যেন মেনে নিয়েছে বৈচিত্র পেরিয়ে এক-কাঠামো গ্রীষ্মের শাসন।
তবু এ পৃথিবীতে বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না। দুর্যোগের দিনেও কে যেন তাই ডাক দিয়ে যায় বসন্তদিনের। কোথাও কিছুই বদলাবে না জেনেও ডেকে যায় একা একা।
হয়তো তারই নাম কোকিল, কিংবা মেহের আলি।