এ যেন কলি যুগের ভীষ্ম। ভীষণ তাঁর প্রতিজ্ঞা। দু-দশক ধরে প্রতিজ্ঞা পালনও করে চলেছেন। তার জন্য চাকরি থেকে আরম্ভ করে খুইয়েছেন অনেক কিছুই। তবুও এতটুকু কমেনি তাঁর জেদ। তাঁর প্রতিজ্ঞাটি কিন্তু বেশ অদ্ভুত। ভদ্রলোকের পণ হল স্নান না-করা। কিন্তু কেন এমন পণ করেছেন তিনি? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
দীর্ঘ ২২ বছর স্নান করেননি। প্রতিজ্ঞা করেছেন যতদিন না মহিলাদের উপর অত্যাচার কমবে ততদিন শরীরে ছোঁয়াবেন না এতটুকু জল। শুধুমাত্র তাই নয়, যতদিন না নিরীহ পশুদের হত্যা করা এবং জমি নিয়ে বিবাদ বন্ধ হয় ততদিন স্নান করবেন না তিনি। বিহারের বৈকন্ঠপুর গ্রামের ধর্মদেব রাম-এর এমন প্রতিজ্ঞা অবাক করেছে তাঁর গ্রামের সকলকেই। তবু প্রতিবেশীদের দাবি, স্নান না করার কোনও প্রভাব তাঁর শরীরে পড়েনি। এতদিনেও নাকি কোনও রকম অসুস্থতাও নেই ধর্মদেবের।
আরও শুনুন: মহিলা সরকারী কর্মীদের জন্য ঋতুকালীন ছুটির কথা ভাবছে না সরকার, জানালেন স্মৃতি ইরানি
৪০ বছর বয়সে সিদ্ধান্ত নেন স্নান না করার। এখনও পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন ধর্মদেব। এরই মাঝে হারিয়েছেন নিজের স্ত্রী ও পুত্রকে। তবু শরীরে ছোঁয়াননি জল। জীবনের শুরুর দিকে তিনি পশ্চিমবঙ্গের জগদ্দলে একটি কারখানায় কাজ করতেন। ১৯৭৮ সালে বিয়েও করেন। তারপরের কয়েক বছর স্বাভাবিক ভাবেই কেটেছে জীবন। হঠাৎই ১৯৮৭ সালে তাঁর উপলব্ধি হয়- চারিদিকে জমি সংক্রান্ত বিবাদ, মহিলাদের উপর হিংসার ঘটনা এবং নিরীহ পশুদের হত্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মনের মধ্যে তৈরি হয় অস্থিরতা। কীভাবে এমন অরাজকতা কমানো যায় তার উত্তর খুঁজতে তিনি এক গুরুর সান্নিধ্যে আসেন। সেখানেই তাঁকে দীক্ষাদান করে গুরু নির্দেশ দেন ত্যাগের পথ অনুসরণ করতে। তখন থেকেই এমন ত্যাগের শুরু। আর ভগবান রাম হয়ে ওঠেন তাঁর আরাধ্য। একটি সাক্ষাৎকারে নিজেই সেকথা জানিয়ে তিনি বলেছেন, গুরুর শরণাপন্ন হওয়ার পরেই তিনি ত্যাগের প্রতিমূর্তি ভগবান রামচন্দ্রের ধ্যান করতে শুরু করেন।
আরও শুনুন: ‘রাষ্ট্রপতি’র স্ত্রী-লিঙ্গ কি ‘রাষ্ট্রপত্নী’? বিতর্কে অধীর-সম্বোধন, ব্যাকরণ কী বলছে?
এমন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার পর মাত্র বছর তিনেক করেছিলেন চাকরি। তারপর আবার ফিরে আসেন গ্রামে। কিন্তু অভাবের সংসারে এমন কাজ না করে বসে থাকার উপায় ছিলনা। বাধ্য হয়েই তাঁকে আবার ফিরতে হয় কারখানার কাজে। প্রথমে ঠিক থাকলেও, কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর এমন অদ্ভুত ত্যাগে কথা জানতে পারেন কারখানার ম্যানেজার। দীর্ঘদিন স্নান না করার কথা শুনে যথেষ্ট বিরক্ত হন তিনি। ততদিনে নিজের দৈনন্দিন আহারটুকুও পরিত্যাগের কথা ভেবেছেন ধর্মদেব। এতকিছুর পরে আর তাঁকে কারখানার কাজে রাখার কথা ভাবেননি ম্যানেজার। কাজ থেকে বহিষ্কার করা হয় ধর্মদেবকে। পুনরায় ঠাঁই হয় গ্রামের ভিটেয়। এত কিছু সমস্যা এই স্নান না করা নিয়ে। তবুও তিনি গায়ে ছোঁয়াননি জল।
আরও শুনুন: জন্ম ১৯৫৬ সালে, একের পর এক ‘কেলেঙ্কারি’র পর্দাফাঁস, কোন বলে এত শক্তিশালী ইডি?
ঘটনা আরও নাটকীয় রূপ পায়, যখন ২০০৩ সালে হঠাৎ তাঁর স্ত্রী মায়া দেবীর মৃত্যু হয়। কিছুদিনের ব্যবধানে মারা যায় তাঁর বড় ছেলেও। তবুও নিজের সিদ্ধান্তে অটল এই বাস্তবের ভীষ্ম। সম্প্রতি মারা গিয়েছে তাঁর আরও এক সন্তান। তারপরেও স্নান করেননি তিনি। যেখানে সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে অহরহ উঠে আসে নারী নির্যাতনের ঘটনা, বা নানান অরাজকতার খবরে চারিদিকে কান পাতা দায় হয় আমজনতার, সেখানে ধর্মদেবের এমন প্রতিজ্ঞাকে নিয়ে অনেকেই হয়তো হাসাহাসি করেন। তবু একথা স্বীকার করতেই হয়, যে কারণের জন্য তাঁর এমন প্রতিজ্ঞা, তা কিন্তু কোনওভাবেই ছোট করা যায় না। ধর্মদেবের প্রতিজ্ঞা যদি সত্যিই ভঙ্গ হয়, তবে আমাদের সমাজই যে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠবে, তা বলাই যায়।