কৌরবদের হাতে বস্ত্রহরণ হয়েছিল দ্রৌপদীর। ভরা রাজসভায় নির্যাতিতা হতে হয়েছিল কুরুকুলবধূকে। কিন্তু শুধুই কি কৌরবেরা? পাণ্ডবদের হাতেও তো লাঞ্ছিতা হতে হয়েছিল তাঁকে। কীভাবে? শুনে নেওয়া যাক।
নারী নির্যাতনের ঘটনা কি কেবল আজকেই ঘটে? প্রাচীন ভারতের মহাকাব্য বলছে, আদৌ নয়। সেই পরম্পরা আগেও জারি ছিল। মহাভারতে দ্রৌপদীকে নির্যাতিতা হতে হয়েছিল ভরা রাজসভায়। অন্তঃপুর থেকে রজস্বলা একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে সভায় টেনে এনে তাঁর বস্ত্রহরণের চেষ্টা করেন দুঃশাসন। নিজের ঊরু দেখিয়ে কুৎসিত ইঙ্গিত করেন কর্ণ। দুর্যোধন-শকুনি সহ কৌরব পক্ষের উল্লাস ফেটে পড়েছিল সেই নিগ্রহের দৃশ্যে।
আরও শুনুন:
বস্ত্রহরণ শুধু নয়, মনে রাখা জরুরি দ্রৌপদীর ন্যায়বিচারের আরজিও, ভোলেননি কৃষ্ণ
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, কেবল কৌরবদের হাতেই কি নির্যাতিতা হয়েছিলেন দ্রৌপদী? পাণ্ডব স্বামীদের হাতেও কি তিনি লাঞ্ছিতা হননি? মহাভারত কিন্তু সে সাক্ষ্যও দেয়।
দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের কাহিনি নারীনির্যাতনের পরম্পরায় মিথের মতো জেগে থাকে। কিন্তু সেই বস্ত্রহরণের মতো কুৎসিত ঘটনা যে ঘটতে পারল, তার নেপথ্যে রয়েছে খোদ যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলা। সে খেলায় নিছক সম্পত্তি হিসেবে পণ রাখা হয়েছিল তাঁকে। আর সেই পণ রাখার সময় রীতিমতো তাঁর রূপবর্ণনা করে তাঁর দর বাড়িয়েছিলেন স্বামী যুধিষ্ঠির। এই পুরো ঘটনাটিই কি দ্রৌপদীর জন্য নির্যাতন নয়?
আরও শুনুন:
নারী নির্যাতন সম্বন্ধে হিন্দু মহাসভার কর্তব্য কী? একশো বছর আগেই মিলেছিল উপদেশ
দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা অবশ্য এখানেই শেষ নয়। ‘দ্রৌপদীর বিচার’ নামে এক প্রবন্ধে খ্যাতনামা সাহিত্য-গবেষক গোপাল হালদার লিখছেন, “তিনি লাঞ্ছিতা, অপমানিতা। তিনি নির্যাতিতা। নারী নির্যাতন অবশ্য তখনকার যুগে কার্যত আর্যদের পৌরুষ ধর্ম ছিল। তাই স্বর্গ-পথেও দ্রৌপদীকে নির্যাতন সহ্য করে যেতে হয়েছে।” সেই নির্যাতন শারীরিক না হলেও মানসিক তো বটেই। মহাপ্রস্থানের পথে দ্রৌপদী যখন পড়ে গেলেন, তাঁর দিকে একবারও আর না তাকিয়ে এগিয়ে গেলেন তাঁর পঞ্চপাণ্ডব স্বামী। ধর্মপুত্র বলে পরিচিত যুধিষ্ঠিরের নির্দেশেই। যুধিষ্ঠির ঘোষণা করলেন, দ্রৌপদী সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য, কেননা তিনি পাঁচ স্বামীকে সমান চোখে না দেখে অর্জুনকে সবচেয়ে বেশি ভালবেসেছিলেন। অথচ, বীর্যশুল্কে দ্রৌপদীকে জয় করেছিলেন তো অর্জুনই। নারীকে এইভাবে জয় করার পদ্ধতিটিও নারীর পক্ষে সম্মানজনক কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে সে কথা সরিয়ে রেখেও বলা যায়, অর্জুনের সাফল্যে তাঁকেই স্বামী বলে জেনেছিলেন দ্রৌপদী। সেখানে তাঁর কোনও মত ছাড়া যে তাঁকে আরও চার পুরুষের অঙ্কশায়িনী হতে হল, এও তো নির্যাতনেরই কাহিনি। তারপরেও দ্রৌপদী আজীবন পাঁচজনের স্ত্রী হিসেবে থেকেছেন, পাঁচজনের সন্তান ধারণও করেছেন। অথচ মহাকাব্যের শেষে এসে তাঁকেই বিচারের নিক্তিতে ফেলা হল। মহাপ্রস্থানের নির্জন পথে একলা ফেলে যাওয়া হল তাঁকে। কেবল কৌরবেরা নয়, দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার আদি অন্ত জুড়ে রয়ে গেল পাণ্ডব স্বামীদের নামও।