প্রেম এসেছিল। নিঃশব্দ চরণে। জানাজানি হলে প্রাণের ভয় ছিল দুজনেরই। তবুও, প্রেম কি আর স্থান কাল পাত্র মানে! তাই বিশ্বযুদ্ধের নাৎসি বন্দিশিবিরেও প্রেমকে আটক করা যায় না। মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গোনা মেয়েকে দেখে গল্প বোনে তাকে পাহারা দেওয়া রক্ষী। শুনবেন নাকি, তাদের কথা?
বাতাসে তখন বারুদের গন্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে অর্ধেক পৃথিবী। জাতিবিদ্বেষের বিষ ছড়াচ্ছে হিটলারের জার্মানি। প্রাণের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে ইহুদিরা। যাদের সে উপায় নেই, তাদের শেষমেশ গতি হচ্ছে কোনও না কোনও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানে সঙ্গী হাড়ভাঙা খাটুনি, আধপেটা খাওয়া, আর প্রবল অত্যাচার। তাতেও যারা মরছে না, তাদের জন্য তো আছেই গ্যাস চেম্বার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কত লক্ষ লক্ষ মানুষকে যে এভাবে মেরেছে নাৎসি বাহিনী, তার আর ইয়ত্তা নেই। এইসব হাড় হিম করা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলির মধ্যেও সবচেয়ে ভয়ংকর যে বন্দিশিবির, সেই বিভীষিকার নাম আউশভিৎজ। নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা, নজিরবিহীন বর্বরতার আরেক নাম ছিল আউশভিৎজ কনসেনট্রশন ক্যাম্প। আর আমাদের গল্পটা শুরু হয়েছিল এখানেই।
আরও শুনুন: নর্তকীর প্রেমে পাগল সাহেব, ভিন ধর্মের যুগলকে কী ‘শাস্তি’ দিয়েছিলেন জাহাঙ্গির?
হেলেনা সিট্রোনোভার জীবনের শেষ দিন ছিল সেই দিনটা। আর কী আশ্চর্য, সেদিনই ফ্রান্ৎজ ভুঙ্ক-এর জন্মদিন। একজন বন্দি, আরেকজন রক্ষী। গ্যাস চেম্বারে পাঠানোর আগে মৃত্যুপথযাত্রী মেয়েটির গলায় গান শুনতে চেয়েছিল ফ্রান্ৎজ। স্রেফ ফুর্তির জন্য। যে জানে কয়েক মিনিট পরেই নেমে আসবে অসম্ভব যন্ত্রণার মৃত্যু, কাঁপা কাঁপা গলায় গান গাইছে সে, এই দৃশ্য দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ত নাৎসি রক্ষীরা। কিন্তু সেদিন কেন কে জানে, বদলে গেল গল্পটা। গ্যাস চেম্বারের দরজা থেকে হেলেনাকে ফের বন্দিশালায় পাঠিয়ে দিল ফ্রান্ৎজ। আর পরদিন সকালে পাঠাল একটা ছোট্ট চিরকুট। জার্মান ভাষায় লেখা তিনটে শব্দ। ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’।
যে লোকগুলো তার উপর, তাদের উপর নারকীয় অত্যাচার চালাচ্ছে, তাদের একজনের সঙ্গে প্রেম? একরাশ ঘৃণা নিয়ে কাগজটার দিকে তাকিয়ে ছিল হেলেনা। কিন্তু এটাও সে বুঝতে পারছিল, জীবন তাকে বাঁচার আরেকটা সুযোগ দিয়েছে। অন্তত আর কটা দিন বেঁচে নেওয়া যায়…
আরও শুনুন: প্রেমের জন্য বন্দুকের ডুয়েল দুই রাজপুরুষের, সাক্ষী ছিল কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি
রাজি হল হেলেনা। শুরু হল এক অদ্ভুত প্রেমের কাহিনি। হেলেনার বুকের ভিতর অন্যজনের প্রতি ভালবাসা নয়, জমে আছে অসম্ভব ঘৃণা। ওদিকে ফ্রান্ৎজ জানে, ইহুদি জাতিকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলাই তাদের লক্ষ্য। সেই জাতির কাউকে ভালবেসে ফেলার শাস্তি কী হতে পারে, সে কথাও তার অজানা নয়। কিন্তু সত্যিকারের প্রেম তো বরাবরই বেপরোয়া। হেলেনার প্রেমে এতটাই পাগল ছিল সে, যে, হেলেনা যখন তার বোনকে বাঁচানোর প্রতিশ্রুতি চাইল, তাতেও দ্বিধা করল না ফ্রান্ৎজ। গ্যাস চেম্বারে পাঠানো হাজার হাজার মানুষের মধ্যে থেকেও হেলেনার বোনকে চিনে নিয়ে তাকে বাঁচাল ফ্রান্ৎজ। এরপর আর তাকে ভাল না বেসে উপায় ছিল না হেলেনার। এর পরেও বহুবার মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েছে সে। প্রতিবারই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রেমিকাকে বাঁচিয়েছে নাৎসি যুবকটি।
না, রূপকথার গল্পের মতো আজীবন একসঙ্গে থাকা হয়নি তাদের। যুদ্ধ ফুরোল। প্রাণের দায়ে পালাতে লাগল নাৎসিরা। পালাল ফ্রান্ৎজও। তবে হেলেনার কথা সে ভোলেনি। নিজের মায়ের ঠিকানা দিয়ে গিয়েছিল তাকে, যাতে সেখানে গিয়ে সুরক্ষিত থাকতে পারে তার প্রেমিকা। হেলেনা অবশ্য সেখানে যায়নি আর। কিন্তু সাতাশ বছর পর আবার একবার দেখা হয়েছিল তাদের। ১৯৭২ সালে, যখন বিচার শুরু হয় ফ্রান্ৎজ-এর। ইজরায়েল থেকে ছুটে এসে তার পক্ষে সাক্ষী দিয়েছিল হেলেনারা দুই বোন। হেলেনার সাক্ষ্যের জোরেই প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল তার এককালের প্রেমিক। ভাগ্যের চাকা ঘুরে গিয়েছিল আরও একবার। প্রেমের জন্যই।