সাধারণ বিশ্বাসে মানুষ ভেবে নেয়, মনমতো টাকা উপার্জন করতে পারলেই জীবনের নব্বইভাগ সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারবে সে। অথচ ভালো মাইনের চাকরি কিংবা আপাত-শান্তির জীবন পেয়েও দিনের শেষে মানুষ কেবল ব্যক্তিগত পরিসরে শান্তির খোঁজ করে। মানসিক উদ্বেগে পাশে দাঁড়ানোর মতো সঙ্গী তো আর অর্থমূল্যে কিনতে পাওয়া যায় না! আর সত্যিই তো, ভাগ করার মতো বন্ধু না পেলে, সুখই বা সুখ লাগে কি?
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে যত কথা বলি আমরা, তার অর্ধেকও বোধহয় বন্ধুত্ব নিয়ে বলি না। বললেও তাতে কোথাও যেন রয়ে যায় অবজ্ঞার রেশ। প্রেমের প্রতি মনে মনে সূক্ষ্ম আস্থা থাকলেও, বন্ধুত্বকে বড়ই হালকা ভাবে নিয়ে থাকি। কত সহজে আমরা বলে থাকি যে বড় হলে আর সত্যিকারের বন্ধু জোটে না মানুষের। জোটে না হয়তো, কিন্তু প্রয়োজনও পড়ে না কী? পূর্ণবয়স্ক মানুষ কি তার দুঃখে-সুখে পাশে দাঁড়ানোর মতো একজন মানুষকে খোঁজে না? যে মানুষ যৌনতা নয়, স্রেফ সমব্যাথী হিসেবেই তার আনন্দ-বেদনায় ভাগ বসাবে…? খোঁজে বৈকি, সম্প্রতি ‘ভাইরাল’ হওয়া এক রেডিট পোস্ট সেদিকেই ইঙ্গিত করে।
পোস্টটিতে এক ব্যক্তি লেখেন তাঁর ব্যঙ্গালুরু নিবাসী এক পরিচিতার কথা। অল্প কয়েক মাস আগেই কর্মসূত্রে ব্যঙ্গালুরুতে বাসা বেঁধেছেন সেই মহিলা। তবে নতুন জায়গায় মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি যে বিষয় কষ্ট দিয়েছে তাঁকে, থাকা-খাওয়া-আবহাওয়ার চাইতেও বেশি, তা হল বন্ধুর অভাব! ইদানিং তাঁকে প্রায় গ্রাস করে নিচ্ছে একাকিত্ব, আর তাই মধ্যবয়সে এসে তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, অন্য সব চাহিদার মতোই ভালো বন্ধুদের পাশে থাকাও ভীষণভাবে জরুরি মানুষের জীবনে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তাঁর বন্ধুটি তাই আবেদন জানিয়েছেন সহৃদয় মহিলাদের উদ্দেশে, কেউ যদি নিজের থেকে এগিয়ে আসতে চায় ব্যাঙ্গালুরু নিবাসী মহিলাটির বন্ধু হতে। কেবল নিখাদ বন্ধুই চাই, যাঁরা মানসিকভাবে সঙ্গ দেবেন, এইটুকু আবেদন কেবল।
শুনতে সাধারণ লাগলেও গভীরে ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে যেখানে চারিদিকে কেবল হিংসে আর বিদ্বেষের চর্চা চোখে পড়ে, সেখানে এমন সরল আবেদন সত্যিই বিরল। সোশ্যাল মিডিয়া হোক বা পথঘাটের মানুষের আলোচনা, কানে আসে কেবল যুদ্ধ অশান্তির কথা। সেখানে দাঁড়িয়ে কোনও মানুষের এত সামান্য চাহিদা শুনলে অবাক লাগাই স্বাভাবিক। তাছাড়া সাধারণ বিশ্বাসে মানুষ ভেবে নেয়, মনমতো টাকা উপার্জন করতে পারলেই জীবনের নব্বইভাগ সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারবে সে। অথচ ভালো মাইনের চাকরি কিংবা আপাত-শান্তির জীবন পেয়েও দিনের শেষে মানুষ কেবল ব্যক্তিগত পরিসরে শান্তির খোঁজ করে। মানসিক উদ্বেগে পাশে দাঁড়ানোর মতো সঙ্গী তো আর অর্থমূল্যে কিনতে পাওয়া যায় না! আর সত্যিই তো, ভাগ করার মতো বন্ধু না পেলে, সুখই বা সুখ লাগে কি?
পোস্টটির কমেন্ট বক্সে দেখা যায়, কেউ কেউ নিজের মতো করে এমন একাকিত্ব কাটানোর সমাধান বাতলেছেন। তবে বেশিরভাগই সেখানে জানিয়েছেন, নিজেদের একাকিত্বের কথা। বলেছেন, কীভাবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা পিছনে ফেলে এসেছেন শৈশবের সরল বন্ধুত্ব। বর্তমানে আর্থিক প্রতিষ্ঠা পেয়েও তাই হৃদয়ের কোন এক গোপন ডেরা ফাঁকাই রয়ে গিয়েছে তাদের। এ প্রসঙ্গে আরও যে বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে, তা হল দৈনন্দিন জীবনে মানসিক স্বাস্থ্যকে ঠিক কতখানি অবহেলা করে থাকে সাধারণ মানুষ। আর্থিক, সামাজিক অবস্থার পাশাপাশি শারীরিক স্বচ্ছলতার কথা যেটুকু বা ভাবা হয়, মানসিক স্বাস্থ্য তার সিকিভাগ গুরুত্বও পায় না। কিন্তু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে, একাকিত্বের যন্ত্রণা নেহাত হেলাফেলার বিষয় নয়। নিজেকে দলছুট অনুভব করা মানুষেরা গভীর মানসিক অবসাদে ভুগতে পারেন। এমনধারা অবসাদ আবার আত্মহননের পথও প্রশস্ত করে থাকে। ফলে যা উপর থেকে দেখে সাধারণ বন্ধুত্বের আবেদন বলেই মনে হচ্ছে, তা হয়তো আসলে সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে চাওয়ার কাতর আর্তি।
কোনও একা মানুষের পাশে দাঁড়ানো এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। বাড়িতে হোক বা কর্মক্ষেত্রে, যে মানুষটা চেয়েও হয়তো মিশতে পারছে না, বন্ধুত্ব পাতাতে পারছে না আশেপাশের মানুষদের সঙ্গে, চাইলে তার কথা একটু ভেবে দেখা যেতেই পারে। সামান্য আড্ডা-ইয়ার্কিতে শামিল করা যেতে পারে। ছোট কোনও দায়িত্ব পালনের ভার দেওয়া যেতে পারে, যা তাকে কিছুটা হলেও বাকিদের সঙ্গে মিশতে সাহায্য করবে। কে-ই বা বলতে পারে, দিনশেষে হয়তো এই সামান্য দু-একটা পদক্ষেপই কোনও দলছুট মানুষের একাকিত্ব মুছতে সাহায্য করবে!