সেতু মানেই তো যোগাযোগ। আবার সেতু মানেই ইট, কাঠ-কংক্রিট দিয়ে বানিয়ে তোলা সহজ যাতায়াতের পথ। কিংবা সেতু মানে হয়তো ‘আয়, আরও বেঁধে বেঁধে থাকি’। অন্তত মেঘালয়ের এই সেতু তো তেমনটাই মনে করায়। শিকড়ের সঙ্গে শিকড়কে আরও আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে নদীর উপরে দিব্যি সেতু বেঁধে দেয় প্রকৃতি। পৃথিবীর বিস্ময় তো বটেই, মেঘালয়ের অন্যতম আকর্ষণ এই সেতু। শিকড়ের ব্রিজ! বিশ্বাস হচ্ছে না তো, শুনেই দেখুন তবে।
লঙ্কা থেকে সীতাকে ফিরিয়ে আনতে সমুদ্রে পাথর ফেলে সেতুবন্ধন করেছিল হনুমান। কথিত আছে, বানরসেনার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেতু গড়তে সাহায্য করেছিল পৃথিবীর সব প্রাণী। বাদ যায়নি কাঠবিড়ালিও।
প্রথম ইট, কাঠ, কংক্রিটের তৈরি ব্রিজটি তৈরি হয় ইংল্যান্ডে, ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে। নিওলিথ বা ইনকা সভ্যতায় দড়িকে সেতুর মতো করে ব্যবহারের ইতিহাস ছিল। তবে সেতু তৈরির ধারণা বোধহয় মানুষ আয়ত্ত করেছে প্রকৃতি থেকেই। নদীর উপরে ভাঙা গাছের গুঁড়ি পড়ে দিব্যি তৈরি হয়ে যায় চলাফেরার রাস্তা। সেখান থেকেই হয়তো পরবর্তীকালে সেতু বানানোর কথা মাথায় আসে।
তবে এই সেতু আলাদা করে গাছের গুঁড়ি কেটে তৈরি হয়নি। গাছেদের মোটামোটা শিকড় একে অপরকে জড়িয়ে জাপ্টে ধরে তৈরি করেছে আশ্চর্য ঝুলন্ত সেতু। তলায় বয়ে চলেছে নদী। উপরে গাছের শিকড়ে শিকড়ে পা দিয়ে দিব্যি যাতায়াত করছে মানুষ। একজন-দুজন নয়, কম করে ৫০ জনকে একই সঙ্গে বহন করার ক্ষমতা রয়েছে এই রুটব্রিজের।
তবে রুট ব্রিজের আয়ু বাঁচাতে এখন চলাচলের জন্য লোক সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
আরও শুনুন: দেবতাজ্ঞানে পুজো করা হয় ইঁদুরকে, দেশের কোথায় আছে এমন মন্দির?
মেঘালয়ে এমন ব্রিজ রয়েছে মোট দুটি। একটি সিঙ্গেল রুট ব্রিজ, দ্বিতীয়টি ডবল ডেকার রুট ব্রিজ।
সিঙ্গেল রুট ব্রিজটি রয়েছে শিলংয়ের মাওলিলং-এ। পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম বলা হয় এই খাসি গ্রামটিকে। সেখানেই রয়েছে এই সিঙ্গেল রুট ব্রিজ। কয়েকশো সিঁড়ি পেরিয়ে নামতে হয় সেখানে। তলা দিয়ে পাথর কাটিয়ে বয়ে চলেছে ছটফটে নদী। তার উপরেই রয়েছে প্রাকৃতিক এই সেতু।
চেরাপুঞ্জির সোহরায় রয়েছে ডবল ডেকার রুটি ব্রিজটি। পর পর দুটি শিকড়ের তৈরি সেতু রয়েছে সেখানে। যেন একতলা আর দোতলা। তবে সিঙ্গেল রুট ব্রিজের তুলনায় এটি আরও বেশি দুর্গম ও নীচে। প্রায় আড়াই হাজার সিঁড়ি পেরিয়ে পৌঁছতে হয় এখানে। ৩০ মিটার লম্বা এই সেতু নাকি ১৮০ বছরেরও পুরনো। তলা দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা।
মেঘালয়ের এই দুটো জায়গাকেই হেরিটেজ আখ্যা দিয়েছে ইউনেস্কো। এমন রুটব্রিজ পৃথিবীর আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না
ভাবছেন তো, কী করে তৈরি হল এই আশ্চর্য রুটব্রিজ?
আরও শুনুন: শক্তিপীঠের অন্যতম হিমাচলের জ্বালামুখী মন্দির, সাতটি শিখা এখানে নেভে না কখনও
জানা গিয়েছে, রাবার গাছের শিকড় জুড়ে জুড়ে প্রাকৃতিক ভাবেই তৈরি হয়েছিল এই রুটব্রিজ। একেকটা শিকড় হয়তো একশো মিটারেরও বেশি লম্বা। ১০-১৫ বছরেরও বেশি সময় লেগেছে সেগুলোকে ঠিকঠাক আকারে আসতে। তবে একবার তৈরি হয়ে গেলে পাঁচশো বছরেও তেমন ক্ষতি হয় না এই রাবারগাছের শিকড়ে। হ্যাঁ, জল খেয়ে খেয়ে কিছু শিকড় নষ্ট হয়েছে বটে, তবে তার জায়গা নিয়েছে নতুন শিকড়।
মজার বিষয় কী জানেন, এই রুটব্রিজগুলোর দেখাশোনা করেন স্থানীয় খাসি মানুষেরাই। মাঝখানে রুটব্রিজগুলোতে চলাফেরার সুবিধার জন্য পাথর ফেলা হয়েছিল। পরে স্থানীয়রা সেসব সরিয়ে ফেলেন। ভারী পাথরের জন্য দুর্বল হয়ে পড়ছিল রুটব্রিজ । তবে অতিরিক্ত পর্যটকদের ভিড়ের চাপ নেওয়া কিন্তু এই ব্রিজের জন্য ক্ষতিকর। এক সঙ্গে বেশি লোক যাতে ব্রিজে না চলাচল করেন, তার দেখাশোনা করেন স্থানীয়রাই।
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস। তার উপরে নদী, পাহাড়ে ঘেরা দুর্গম ভূখণ্ড। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই স্থানীয় জনজাতির জীবন এখানে সহজ নয়। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভাণ্ডার বলা চলে এই মেঘালয়কে। ফলে স্বভাবতই পর্যটকদের কাছে এ জায়গার দাম কম নয়। পর্যটনের খাতিরেই নিজেদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে বাঁচিয়ে রাখতে চান স্থানীয়রা। প্রশ্নটা রুজিরুটিরও।