রং যদি বসন্তের পরিচয়পত্র হয়, তবে সেখানে বারোমাস বসন্তকাল। বোধন, বিসর্জনের হিসাব রাখে পঞ্জিকা। আর রঙের রসায়নের খবর রাখে শিল্পীর হাতের পাতা। তুলির সোহাগে রঙের চেতনা সেখানে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে মৃৎপ্রতিমার। একফালি গলিতে যেখানে রং নামিয়ে আনে এক-আকাশ স্বপ্ন, তারই কিছু রং অক্ষরে ছড়িয়ে দিলেন সুলয়া সিংহ।
ছবি: শুভ্ররূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
রং যেন ফুরোয় না। রঙের উদ্ভাসে মাটিই সেখানে আকাশ। এদিকে বসন্তের ব্যাকরণ মেনে এই সময়টা দিনকয়েক ডুব দেয় রঙে। প্রকৃতিতে রঙের স্থানীয় সংবাদ অবশ্য বেশ কিছুদিন আগে থেকেই প্রচারিত। সেই রঙে রং মিলিয়ে মানুষও মাতে উৎসবে। জলে-স্থলে-বনতলে রাঙা হিল্লোল। ফুলের আগুন যেন রঙের শিখা হয়ে অন্তরকে শুদ্ধ করে। প্রেমে-প্রাণে-গানে-স্বাদে-আহ্লাদে সময়টা যেন সবদিক থেকেই বড় রঙিন। আর সেখানে, যেখানের কথা বলা শুরু করেছিলাম, সেখানে তো বারোমাসই বসন্তকাল। রং যদি বসন্তের পরিচয়পত্র হয়, তবে এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বোধন, বিসর্জনের হিসাব রাখে পঞ্জিকা। আর রঙের রসায়নের খবর রাখে শিল্পীর হাতের পাতা। তুলির সোহাগে রঙের চেতনা সেখানে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে মৃৎপ্রতিমার।
আসলে দুর্গাপুজো আর কুমোরটুলিকে আমরা সমার্থক করে রেখেছি। তা অবশ্য ভুল কিছু নয়। তবে, কুমোরটুলি যে কেবল মা দুগগার তা তো নয়। বারো মাস সেখানে শিল্পের চর্চা। ভাস্কর্য আর চিত্রকলার যুগলবন্দি অতএব কুমোরপাড়ার পদাবলিতে রং এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। যে প্রতিমা দেখে আমাদের চোখ ভরে ওঠে, তা যেমন ভাস্কর্যের সার্থক নমুনা বহন করে; তেমনই থাকে সেখানে রঙের বিচিত্র কারুকাজ। শুধু যদি প্রতিমার চোখেই চোখ রাখা যায়, দেখা যাবে রং কী সূক্ষ্মতায় সেখানে বাঙ্ময়। কুমোরটুলির শিল্পীদের পরম্পরা যেন রঙের তারতম্যেই এঁকে দেয় স্বতন্ত্র চিহ্ন। শহরে এত বড় আর্ট গ্যালারি আর দ্বিতীয় নেই, যেখানে রঙের বসন্ত কেবল দু-মাসে ফুরোয় না।
কুমোরপাড়ার ক্যানভাসে কেবলই রঙের জন্ম। যে রঙে কখনও রঙিন হয়ে ওঠে দুর্গা, কালী, সরস্বতী, তো কখনও রং মাখামাখি করে ফাইবারের মূর্তি নিমেষে নেয় অন্য রূপ। সবই শিল্পীদের হাতের তুলির টানের কারসাজি। সৃষ্টিসুখের উল্লাসে প্রতিনিয়ত রঙিন হয় কুমোরটুলি। রঙের সঙ্গে রংয়ের মিশ্রণে নতুন রং শুধু নয়, জন্ম হয় নতুন স্বপ্নেরও। একফালি গলির ভিতর এক আকাশ রঙিন সেই স্বপ্ন। এই রংই তো ওই সৃষ্টিকর্তাদের সংসারে খাবার জোগান দেয়, সাঁঝে তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালায়। তাঁদের কাছে তাই রং উৎসব তো বটেই, রুজিরুটিও।
জন্মলগ্ন থেকেই কিন্তু এতখানি রঙিন ছিল না কুমোরটুলি। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যায়, জব চার্নক কলকাতায় পা রাখার আগেই কুম্ভকাররা একসঙ্গে উত্তর কলকাতার এই প্রান্তে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। সে সময় এই এলাকায় তৈরি হত মাটির হাঁড়ি, কলসী, থালা, বাটি, গ্লাস। সেসবই পৌঁছে যেন বিভিন্ন জায়গায়। ধীরে ধীরে পটপরিবর্তন ঘটে। কাঁসা-পিতলের ব্যবহার বাড়তে থাকায় গুরুত্ব হারায় মাটির সরঞ্জাম। সেসময় কৃষ্ণনগর থেকেই রুটিরুজির জন্য কারিগররা এই কুমোরপাড়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। বাড়তে থাকে পুতুল গড়ার চল। পরবর্তীতে রাজপরিবারগুলিতে দুর্গাপুজোর রীতি চালু হলে বেড়ে ওঠে কুমোরটুলির কদর। সেসময় বাড়িতে তৈরি নানা ভেষজ রঙেই রাঙিয়ে তোলা হত মূর্তি কিংবা প্রতিমা। হলুদ, লাল, সাদা রঙের ব্যবহার ছিল বেশি। মা দুর্গার গায়ের রং হত উজ্জ্বল হলুদ। সিংহ হত সবুজ। আবার দুর্গার পায়ে পরানো হত আলতা।
এই ছবি খানিকটা বদলে যায় শিল্পী গোপেশ্বর পাল ও রমেশ পালের হাত ধরে। কুমোরটুলির আকাশে ঢুকে পড়ে গোলাপি ও কমলা রং। বাকিটা ইতিহাস। এখন এ পাড়ায় বারো মাসই রঙের খেলা। শিল্পী মালা পাল বলছিলেন, মৃন্ময়ী দুর্গাকে রঙিন করতে এখনও তাঁরা সম্পূর্ণ বাইরের কেনা রঙের উপর ভরসা করতে পারেন না। বরং রং তৈরি করে নিলেই তা মনের মতো হয়ে ওঠে। এই যেমন খড়িমাটির সঙ্গে প্লাস্টিক পেন্ট মিশিয়ে নিলে সাদা রং আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আবার বড় প্রতিমা দেখে অনেক সময় ওয়েল কালারের মতো উজ্জ্বল মনে হয়। কিন্তু সেটা ওয়েল রং নয়। খড়িমাটি, স্টেনার, প্লাস্টিক পেন্ট মিশিয়ে গার্নিস করলেই ওরকম চকচক করে ওঠে। ফাইবারের উপর ধরে ওয়েল রং। কোনও মূর্তিতে কমলা রং করতে হলে সাদার সঙ্গে লাল মেশালেই পদ্মের পাঁপড়ির মতো রং হয়ে যায়। সেটা দারুণ লাগে। শিল্পী বঙ্কিম পাল জানালেন, এখন আর সেভাবে ভেষজ রং ব্যবহার করা হয় না। সারা বছরই কিছু-না-কিছু অর্ডার আসতে থাকে। ফলে রেডিমেড রঙের উপরই ভরসা রাখতে হয়। তবে রঙের মিশ্রণের ক্ষেত্রে খড়িমাটি বড় ভূমিকা পালন করে।
বারো মাসে তেরো পার্বণের সৌজন্যে এই শিল্পীদের হাতের পাতা কখনও রংহীন হয় না ঠিকই। কিন্তু দোলযাত্রায়? সেদিন কেমন হয় কুমোরটুলির ছবিটা? সৌমেন পালের কথায়, মহালয়ার পর দেবী দুর্গা কুমোরপাড়া ছাড়লে যেমন ঝপ করে নিস্তব্ধতা নামে, দোলে কুমোরটুলির ছবিটা হয় এক্কেবারে উলটো। ধুমধাম করে গোপাল পুজো হয়, শিল্পীরা মিলে আবির খেলেন। বসন্ত উৎসবে আরও রঙিন হয় মৃৎশিল্পের আঁতুড়ঘর।
এ-শহর শিল্পরসিক। রঙের সমঝদারও। রঙের তারতম্য, সে শিল্পে হোক বা রাজনীতিতে, তার নজর এড়ায় না। সেই শহর জানে, সাধের কুমোরটুলির রং যেমন ফুরোয় না, তেমন বদলায়ও না। বাঙালিয়ানার আত্মচিহ্ন হয়ে সেই রং গড়িয়ে যায় ইতিহাস থেকে আধুনিকতার দিকেই।