গভীর রাত। রাস্তাঘাট শুনশান। কোথাও মানুষের চিহ্নমাত্র নেই। দোকানপাটও বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ। রাস্তার মোড়ের একমাত্র আলোটা জ্বলছে-নিভছে। হঠাৎ কোত্থেকে যেন ভেসে এল কান্নার শব্দ। তবে মানুষের নয়, কুকুরের। আকাশের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভাবে চিৎকার করছে অবলা প্রাণীটি। কিন্তু সেই মুহূর্তে তাকে অবলা ভাবতে চাইবেন না অনেকেই। কারণ সিনেমা বা গল্পের দৌলতে এই দৃশ্য ভাবলেই, গায়ে কাঁটা দেয়। সেইসঙ্গে ভিড় করে নানা কুসংস্কার। কিন্তু সত্যিই কি কুকুরের কান্না কোনও ভৌতিক ঘটনা? কিংবা এরসঙ্গে কোনও অশুভ যোগ কি রয়েছে? আসুন শুনে নিই।
রাত বাড়ছে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কুকুরের কান্না। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাতবিরেতে কুকুরের কান্না শুনলে ঘুমের কথা অনেকেই বিশেষ ভাবতে চান না। উলটে মনে ভিড় করে অজানা ভয়। সেইসঙ্গে নানা কুসংস্কার। এমনকি তথাকথিত শিক্ষিতরাও কুকুরের কান্নার মধ্যে অশুভ ইঙ্গিত খুঁজে পান।
আরও শুনুন: নিজেই বানালেন বিশ্বকাপের অ্যান্থেম, নেটদুনিয়ায় বেজায় খোরাকের শিকার পাক ব্যক্তি
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এমনটা কি সত্যিই হয়?
একেবারেই না। প্রথমত এই যুক্তির কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। তবু কেউ যদি তর্কের খাতির শাস্ত্রের প্রসঙ্গ টানেন, তাহলে সেখানেও কোনও সদুত্তর মিলবে না। স্রেফ লোক বিশ্বাসের উপর ভর করেই এই ধারণা প্রচলিত হয়েছে। যদিও সেই লোকবিশ্বাস তৈরির ক্ষেত্রে, একটা যুক্তি মিলতে পারে। কুকুর, বেড়াল জাতীয় প্রাণীরা রাতের অন্ধকারেও দেখতে পান। এর বিজ্ঞানসম্মত কারণ রয়েছে। তাই অনেকেই মনে করেন, যা সাধারণ মানুষের চোখে ধরা পড়ে না, সেই অপার্থিব সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পায় এই প্রাণীরা। কিন্তু তেমন কিছু দেখলে তারা চিৎকার করবে। রাতের বেলা অচেনা কাউকে দেখলে যা হামেশাই করে থাকে পাড়ার লালু, ভুলুর দল। কিন্তু খামোকা তারা কাঁদতে যাবে কেন?
আরও শুনুন: মুক্তি পাক যুদ্ধে নিহতদের আত্মা, পিতৃপক্ষে গয়ায় পিণ্ড দান ইউক্রেনের মহিলার
আসলে এর নেপথ্যেও রয়েছে খুব সাধারণ কিছু কারণ। সাধারণ বলতে, কোনও মানুষ ঠিক যে কারণে কাঁদে, কুকুররাও সেই কারণেই কাঁদে। যেমন ব্যাথা পেলে। বাইরের চোট না থাকলেও, হাড়ের যন্ত্রণা কিংবা নিছক পেটব্যাথা আমাদের কাহিল করে দেয়। কুকুরদের ক্ষেত্রেও এমনটা হতেই পারে। তাদের শরীরও রক্ত মাংস হাড় দিয়েই তৈরি। তাই সেখানে ব্যাথা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর এমনটা হলে তারা করুন এক স্বরে চিৎকার করে। যা শুনে অনেকেরই অপার্থিব মনে হয়। এছাড়া রাস্তার কুকুরদের ক্ষেত্রে পেটের সমস্যা দেখা যায় প্রবলভাবেই। কেউ নিয়ম করে খেতে না দিলে পেট ভরানোর জন্য তাদের যা খুশি খেতে হয়। এর থেকে অনেক সময় গ্যাস বা ওই ধরনের পেটের সমস্যা হতে পারে। যার থেকে যন্ত্রণা হলেই ওই অবলা প্রাণী করুন সুরে ডাকে। শুধু তাই নয়, স্বভাবগত ভাবেই কুকুর একা থাকতে পছন্দ করে না। তাই কোনওভাবে মানুষের দেখা পেলে কিংবা তার যদি কোনও সঙ্গী না থাকে, তাহলেও রাতবিরিতে কান্না জুড়তে পারে ওই চারপেয়ে। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যেই এক অদ্ভুত ভয় কাজ করে। তাই কান্নার শব্দ শুনে মনে হয় কুকুরটি কিছু দেখে ওমন করছে। কিন্তু তা একেবারেই নয়। এই ভয় আসলে একাকীত্বের ভয়। সবাইকে ছেড়ে থাকা ওদের কাছে আতঙ্কের মতো বিষয়। পাশাপাশি খুব কম বয়সের কুকুর, সোজা কথায় বলতে গেলে কুকুরছানা কারণে অকারণে কান্না জুড়তে পারে। ঠিক মানবশিশুর মতোই। তারাও যেমন মা-কে দেখতে না পেলে কান্না শুরু করে, কুকুরছানাদের স্বভাবও ঠিক তেমনটাই। তবে সবথেকে বেশি যে কারণে কুকুরকে কাঁদতে দেখা যায়, তা হল খিদে। যেসব কুকুর তুলনামূলক ভাবে দুর্বল, তারা অনেকসময়ই খাবার জোগাড় করতে পারে না। কারণ পশুদের ওই জগতে বেঁচে থাকার একমাত্র মন্ত্র, অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম। এবার একদিন না খেলে কেউ তো আর মরে যাবে না। কিন্তু কষ্ট হবে, প্রচন্ড যন্ত্রণা হবে পেটের ভিতর। আর সেই কষ্টের বহিঃপ্রকাশ হয় কান্নার মাধ্যমে। তবে এই প্রসঙ্গ ধরেই অশুভ ইঙ্গিত কথা বলা যায়। সাধারণত কোনও পাড়া বা এলাকার মানুষ কিছু না কিছু বাড়তি খাবার বাইরে ফেলে দেন। সেইসব খেয়েই পেট ভরে পাড়ার কুকুরদের। কিন্তু কোনওকারণে যদি তা বন্ধ হয়, তাহলে বুঝতে হবে গোটা পাড়ায় বা ওই এলাকায় কোনও সমস্যা হয়েছে। হয়তো সেখানে যারা থাকেন তারা নিজেদের খাবারই ঠিকমতো জোগাড় করতে পারছেন না। অদূর ভবিষ্যতে তাই সেই এলেকার মানুষের জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে তা বলাই বাহুল্য। সেইসঙ্গে ইঙ্গিত হিসেবে যোগ হয় কুকুরের কান্না। যদিও এই ধারণার প্রেক্ষিতেও বিজ্ঞানের যুক্তি খাটে না। তাই একথা স্পষ্ট করেই বলা যায়, কুকুরের কান্না কোনও অপার্থিব বিষয় নয়। এর সঙ্গে কোনও ভূতের যোগও নেই। রয়েছে এই অবলা প্রাণীর চাপা কষ্টের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।