হিন্দুমতে বিয়ের হাজারও নিয়মকানুন থাকলেও, আইনি বিয়ের ক্ষেত্রে স্রেফ একটা সই-ই যথেষ্ট। তবে সম্প্রতি এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতির দাবি, যতক্ষণ না বিবাহ যথাযথ আচার মেনে হচ্ছে, ততক্ষণ সেই বিয়েকে বৈধ বলা যায় না। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে সাতপাকে ঘোরা রীতিটি উল্লেখ করেছেন তিনি। কী এমন বিশেষত্ব রয়েছে এই নিয়মের? আসুন শুনে নিই।
ধর্মীয় আচার ছাড়া হিন্দু বিবাহ অবৈধ। সম্প্রতি এক মামলায় এমনই পর্যবেক্ষণ এলাহাবাদ হাই কোর্টের। এ বিষয়ে বিচারপতির দাবি, হিন্দু বিবাহ আইনে সপ্তপদী বা সাত পাকে ঘোরার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বিচারাধীন বিবাহ সংক্রান্ত মামলায় সেই রীতির উল্লেখ ছিল না। তাই সেই বিয়েকে অবৈধ বলেই দাবি করেন বিচারপতি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে হিন্দু বিয়েতে এই রীতি পালন করা হয় কেন?
আরও শুনুন: পুজোর কেনাকাটায় বিল মেটাচ্ছেন কিউআর স্ক্যানে? সাবধান না হলে ফাঁকা হবে ব্যাঙ্ক
বিয়ে মানে এক সামাজিক বন্ধন, যেখানে দুজন মানুষের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিভিন্ন ধর্মে বিয়ের জন্য আলাদা আলাদা ধরনের নিয়ম রয়েছে। এমনকি ধর্মবিশ্বাস ভেদে বদলায় বিয়ের পোশাকও। হিন্দুমতে বিয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় না। পাত্র-পাত্র দুজনকেই সারাদিন নানা আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তবে বিয়ের চলাকালীন যা কিছু আচার পালনের নিয়ম তা দুজনকে একসঙ্গেই পালন করতে হয়। হিন্দুমতে বিয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত পাত্র হাজির হন পাত্রীর বাড়িতে বিয়ের জন্য। সেখান থেকে বিয়ে করে পাত্রীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসাই প্রচলিত রীতি। বর্তমানে যদিও অনেকেই সে নিয়ম মানেন না। তবে বিয়ের নিয়মে বিশেষ রদবদল হয়নি বললেই চলে। প্রচলিত নিয়মে, পাত্র বিয়ে করতে হাজির হন নির্দিষ্ট লগ্নের বেশ কিছুক্ষণ আগেই। কারণ বিয়েতে বসার আগে আরও কিছু সামাজিক নিয়ম পালনের রেওয়াজ রয়েছে। বরমশাইকে বরণ করা, কনেকে তার চারপাশে ঘোরানো, শুভদৃষ্টি, মালাবদল এইসব শেষ হলে আসল বিয়ের কাজ শুরু হয়। হিন্দু বিয়ের ক্ষেত্রে অগ্নিকে সাক্ষী রাখা শাস্ত্রীয় রীতি। তাই যাবতীয় লৌকিক আচার শেষ হলে, পাত্র-পাত্রীকে বসিয়ে শুরু হয় যজ্ঞ। ‘যদিদং হ্রদয়ং…’ মন্ত্রে প্রজাপতি ব্রহ্মার উদ্দেশ্যে আহুতি দেন তাঁরা। সেইসঙ্গে মন্ত্রের আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হন দুজনেই। তবে এই পর্বের মূল আকর্ষণ সাতপাকে ঘোরা। বিভিন্ন গান, সিনেমা কিংবা লোককথায় এই ‘সাতপাকে ঘোরা’-র প্রসঙ্গ ফিরে আসে বারবার। মনে করা হয়, এই রীতি পালনের মাধ্যমেই দুজন দুজনকে আগামী জীবন একসঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।
আরও শুনুন: জেলে পড়াশোনা করেই স্নাতক, স্নাতকোত্তর! ১৪৫ জন বন্দির সাজা কমল এই রাজ্যে
তবে এই নির্দিষ্টভাবে সাতপাকেই কেন, তারও রয়েছে বিশেষ ব্যাখ্যা। প্রতিটি পাকের রয়েছে বিশেষ তাৎপর্যও। প্রথম পাকে দম্পতি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন, তাঁরা একে অপরের খাদ্য এবং স্বাচ্ছন্দ্যের দায়িত্ব নেবেন। দ্বিতীয় পাকের সময় যে মন্ত্র উচ্চারিত হয় তা নির্দেশ করে, পাত্র-পাত্রী আগামীদিনে দু’জন দু’জনের জীবনে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য বজায় রাখবেন। তৃতীয় পাকে, দম্পতি একসঙ্গে প্রতিজ্ঞা করেন, তাঁরা সব রকম আধ্যাত্মিক কর্তব্য পালন করবেন, সামাজিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেবেন। চতুর্থ পাকে একে অপরকে পরিপূর্ণতা দেওয়া এবং দুজনের পরিবারকে সবরকমের বিপদ থেকে রক্ষার শপথ নেন দম্পতি। পঞ্চম পাক ভালোবাসার। এর মাধ্যমে তাঁরা একে অন্যকে ভালবাসা এবং সম্মান দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হন। ষষ্ঠ পাকে দুজনে আগামী জীবন সুস্থ এবং রোগহীন হয়ে কাটানোর প্রার্থনা করেন। সপ্তম এবং শেষ পাক বিবাহ সম্পন্ন হওয়াকে নির্দেশ করে। এই পাকের শেষে ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে দাম্পত্য সম্পর্কের সূচনা করেন যুগল। তবে এতো গেল শাস্ত্রের কথা। এই নিয়ম ঘিরে প্রচলিত এক লোককথা রয়েছে। বলা হয়, সাতপাকে ঘোরার অর্থ, আগামী সাত জন্মের জন্য একে অপরের সঙ্গে বাঁধা পড়া। যদিও আইনি বিয়ের ক্ষেত্রে এসবের কোনও বালাই নেই। স্রেফ নির্দিষ্ট জায়গায় সই, আর সাধারণ কিছু নিয়ম মানলেই সরকারি খাতায় দুজন বিবাহিত হিসেবে পরিচত হন। তবে এলাহাবাদ হাই কোর্টের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে নতুন করে চর্চায় উঠে এসেছে হিন্দু বিবাহের নিয়ম কানুন।