নিঃশব্দে একের পর এক প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়ে উঠেছিল মেরি ম্যালনের নেশা। কৌশলটি ছিল রোগজীবাণু ছড়িয়ে দেওয়া। মারণরোগের জীবাণু বয়ে বেড়াতেন শরীরে, তবু নিজে ছিলেন একেবারে সুস্থ। নিতান্ত একজন সাধারণ হলেও মানুষের কাছে মূর্তিমান ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কেন এমন হত্যালীলা চালাতেন মেরি? কীই বা হয়েছিল তাঁর শেষ ফলাফল? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
সাধারণ এক তরুণী। আর পাঁচজন মেয়ের মতোই। অথচ কে জানত, তাঁর শরীরেই লুকিয়ে আছে ভয়াবহ মৃত্যু পরোয়ানা! হিসেব বলে, শুধুমাত্র তাঁরই দৌলতে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় সাড়ে ছশো মানুষের। তাঁর স্পর্শে একের পর এক মানুষের উপর নেমে এসেছিল মৃত্যুর কালো ছায়া। মেরি ম্যালন, যেন মহামারিরই অন্য নাম।
বিশ শতকের শুরুতেই আতঙ্কের আরেক নাম হয়ে উঠেছিল মেরি ম্যালন। ইতিহাসের পাতায় যে-কটি মহামারির কথা উল্লেখ করা আছে, তার অন্যতম নাম মেরি ম্যালন। তাঁর ভিতরে বেড়ে উঠেছিল এক ভয়াবহ ঘাতক। আর সেই স্পর্শে একের পর এক প্রাণ কেড়ে নিয়েছেন তিনি।
শুধুমাত্র মশা-মাছি কিংবা রোগজীবাণুর প্রকোপ নয়। মহামারি হতে পারে একজন সুস্থ মানুষের থেকেও। আর তারই উদাহরণ মেরি ম্যালন। দেহে ছিল টাইফয়েড সৃষ্টিকারী ভয়ানক ব্যাকটেরিয়া সালমোনেলা টাইফি। অথচ নিজে ছিলেন এক্কেবারে সুস্থ। শুধুমাত্র তাঁরই কারণে ১৯০৬ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে নাকি ৩৪৬৭ জন টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সরকারি নথিতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছিল ৬৩৯ জনের। তবে অঙ্কের পরিসংখ্যান হয়তো তার চেয়ে ছিল অনেক বেশি। এমনকী আশপাশে, পাড়ায় কিংবা গ্রামাঞ্চলে এলাকাভিত্তিক সংক্রমণও ঘটেছিল, যার তথ্য সরকারি নথিতে নেই।
তাহলে বিশদেই গল্পটা বলা যাক। তবে গল্পের মতো শোনালেও এ মোটেই কোনও সাইকো থ্রিলারের প্লট নয়। একেবারে বাস্তব ঘটনা থেকেই উঠে এসেছে মেরি ম্যালন।
আরও শুনুন: গোটা রেলগাড়ি জুড়ে চলেছেন মারণরোগীরা, পাঞ্জাবের ‘ক্যানসার ট্রেন’ দেশে অশনিসংকেত
১৮৬৯ সালে আয়ারল্যান্ডে জন্ম হয় মেরির। তবে তাঁর রোগ ছড়িয়ে বেড়ানোর বিষয়টি সামনে আসে ১৯০৬ সালে। চার্লস হেনরি ওয়ারেন নামে এক ব্যক্তির হেঁশেলে রাঁধুনির কাজ নেন মেরি। আর ওই শুরু। সেই বাড়িতে দেখা দিল টাইফয়েডের প্রাদুর্ভাব। মোট ১১ জন সদস্যের মধ্যে ছ-জনই পড়ল টাইফয়েডের কবলে। ঘটনার তদন্তে নামলেন হেনরি। গোটা বাড়ি তন্নতন্ন করে খানাতল্লাশি করেও মিলল না টাইফয়েডের কোনও উৎস। ইতিমধ্যে মেরি সেই ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। তারপর আরও আটটি পরিবারে একে একে মেরি রান্নার কাজ নেন, এবং তার মধ্যে সাতটি পরিবারে মেরি ছড়িয়ে দেন সেই মারণব্যাধি।
শোনা যায়, মেরি খুব ভালো করেই জানতেন তিনি সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। আর সেই বুঝে পরিকল্পনামাফিক বিভিন্ন ঠান্ডা খাবার, যেমন আইসক্রিম, ফলের রস প্রভৃতির মধ্যে মেরি চুপিচুপি ঢেলে দিতেন তার শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়া। কখনও তাঁর এঁটো খাবার, কখনও আবার শরীরের বর্জ্য তিনি নিঃশব্দে মিশিয়ে দিতেন খাবারে। ব্যস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সফল হত তাঁর পরিকল্পনা। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত মানুষগুলো।
শেষমেশ অবশ্য ধরা পড়েন মেরি। শুরু হয় চিকিৎসা। কিন্তু মেরি নাছোড়বান্দা। কিছুতেই তিনি সুস্থ হবেন না। তাই হাত ধোয়ায় অনীহা, মল-মূত্র ত্যাগের পর নিজেকে ঠিকমতো পরিষ্কার না করেই রান্না করা- এ সব কিছুই তিনি বজায় রেখে চলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে নির্বাসিত করা হয় মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে, দ্বীপের মধ্যে একটি বাংলোতে। তাঁর হাত থেকে বাঁচতে মৃত্যুর শেষ ২৮ বছর তাঁকে রাখা হয় কোয়ারেন্টাইনে। জীবনের শেষ পর্যায়ে মেরি পক্ষাঘাতে অবশ হয়ে গেছিলেন। তবুও শরীর থেকে যায়নি ব্যাকটেরিয়া। ১৯৩৮ সালে নভেম্বর মাসে মারা যান ‘টাইফয়েড মেরি’।
বছর কয়েক আগেই ভয়াবহ করোনা অতিমারি আমাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তবে করোনার আগেও একাধিকবার বিশ্বের ওপর আছড়ে পড়েছে আর একাধিক মহামারি। কিন্তু সেসবের ভিড়েও হারিয়ে যায়নি মেরির নাম। বরং এক নিঃশব্দ ঘাতক হয়ে মেরি রয়ে গেছেন ইতিহাসের পাতায়।