উৎসব আসে উৎসব যায়। চেহারা বদলায় শহর। সবথেকে রঙিন হয় বসন্তকালে। উৎসবও সেই বসন্তের নামেই। তার একদিকে রঙের বাহার, অন্যদিকে স্বাদের। সেখানেও রঙের ছড়াছড়ি। দুধসাদা কিংবা ঘন সবুজ। কখনও আবার হালকা গোলাপের রং। তবে এই রং মাখার নয়, চেখে দেখার। খোঁজ নিলেন শুভদীপ রায়।
ওটা বড়দের জিনিস। কোনওকিছু সম্পর্কে কৌতুহল বাড়িয়ে তোলার জন্য এই তিনটে শব্দই যথেষ্ট। তা সে কোনও খাবার হোক, বা পড়ার। তার মধ্যেই পড়ে বিশেষ এক শরবত। অবশ্য যে কোনও শরবতই এই বিশেষত্ব পেতে পারে। সঙ্গে স্রেফ মেশাতে হবে ‘ভাং’।
সে তো নেশার জিনিস। হ্যাঁ, কোনও সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু বছরের বিশেষ ক-টা দিনে এই নেশায় বুঁদ হতেই অনেকে ছুটে যান চেনা শহরের অচেনা গলিতে। চুমুক দেন অন্য রকম রঙিন গ্লাসে। উত্তর কলকাতার কথাই ধরা যাক। নিমতলা ঘাটের কাছে ভূতনাথ মন্দির। তার থেকে কয়েক পা এগোলেই শরবতের দোকান। হরেক স্বাদের শরবতের সঙ্গেই মিলবে সেই কাঙ্ক্ষিত জিনিস। একটা নয়, ৩-৪ রকমের ভাং রয়েছে। দামও আলাদা। সহ্য করার ক্ষমতা বুঝে বাছতে হবে। বাকিটা যিনি খাবেন তাঁর ব্যাপার। যদিও দোলের সময় এদিকটায় তেমন ভিড় চোখে পড়ে না। ভিড় জমে মূলত বি কে পাল অ্যাভিনিউ-এর মুখে। সেখানেই কলকাতার অন্যতম পুরনো ভাং-এর দোকান- ‘শিব-শক্তি’।
ঠিক কেন শিবের নাম তা আলাদা করা বলার অপেক্ষা রাখে না। মহাদেবের সঙ্গে যেভাবে নেশাদ্রব্যের নাম জড়িয়ে ফেলেন অনেকে, তেমনই কারও মস্তিষ্কপ্রসূত এই নাম। সঙ্গে রয়েছেন স্বয়ং শক্তিও। দোকানের বর্তমান মালিক গৌরব গুপ্তা। তিন পুরুষ ধরে তাঁরাই এই দোকানের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। আলাদা করে কোনও কর্মী চোখে পড়ে না। একাই সবটা সামলান। বিক্রি থেকে শুরু করে শরবত তৈরি করা- সবই।
দোল আর শিবরাত্রির সময় এই দোকানে ভিড় উপচে পড়ে। কারণ এই সময় ভাং-এর চাহিদা থাকে সবথেকে বেশি। বছরের অন্যান্য সময় বিক্রি হয় নানা ধরনের সাধারণ শরবত। দোকানের মালিক গৌরবও এই দোকানকে স্রেফ ভাং-এর দোকান বলতে নারাজ। জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেন ঠান্ডাই-এর দোকান। সঙ্গে ভাং-ও মেলে। এখানেও ভাং-এর বেশ কিছু ধরন রয়েছে। শরবতে তো বটেই, ভাঙের লাড্ডুও বিক্রি হয় এই দোকানে। ৪০ টাকা থেকে শুরু। ১২০ টাকা অবধি শরবত বা ভাং লাড্ডু মিলতে পারে এই দোকানে। প্রায় ৬০ বছরের পুরনো এই দোকান সেই অর্থে গলিতে না হলেও, বছরের অন্যান্য দিন এই দোকান আলাদা ভাবে কারও চোখে পড়ে না।
এবার সোজা হাতিবাগান হয়ে হেদুয়া। কলেজস্ট্রিটের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে রাস্তার ডানদিকে পরপর দুটো শরবতের দোকান। প্রথমটা সেই শিবের নামে। অনেকেই কলকাতায় ভাং বলতে এই ‘শিব আশ্রম’ দোকানটিই চেনেন। ভিড় মূলত কলেজ পড়ুয়াদের।
বসন্ত উৎসবের শাড়ি-পাঞ্জাবিরা প্রতিবছর এই আশ্রমে ভিড় জমায় ভাং-এর লোভে। এখানে কোনও লাড্ডুর ব্যাপার নেই। সবই শরবত। তার মধ্যে মেশানো হয় ভাং। দাম বেশ চড়া। এমনি শরবত বা লস্যি ৫০ টাকার মধ্যে পেলেও ভাং-এর জন্য খরচ করতে হবে অন্তত ৮০। এরপর ১০০, ১৫০০ ২০০ টাকা অবধি ভাং শরবত মেলে। কিন্তু প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই শরবতের পরিমাণ এক। দোকানি নিজেও জিজ্ঞাসা করে নেন পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে কি-না। সেইমতো বলেন কত দামের শরবত খেলে মোটামুটি সব ঠিক থাকবে। এর কয়েক পা দূরেই লোকনাথ আশ্রম। সেখানে অবশ্য ভাঙের ধরন দু-রকম। ৯০ আর ১০০ টাকার। হিসাবটা পাশের দোকানের মতোই। দোলের মোটামুটি এক সপ্তাহ আগে থেকেই এই দোকানে ভিড় জমা শুরু হয়।
দুটো দোকানকেই ফেলে এগিয়ে গেলে কলেজ স্ট্রিট মোড়। সেখানে রয়েছে কপিলা আশ্রম। দামের দিক দিয়ে এই দোকান খানিকটা সস্তা। তবে মানের ক্ষেত্রে এখানকার শরবত তুলনাহীন। এর কাছেই প্যারামাউন্ট। পুরোদস্তুর শরবতের দোকান। তবে সেখানে ভাং মেলে না। তা পেতে গেলে এবার যেতে হবে বড়বাজার। সেইভাবে কোনও নাম নেই দোকানের। তবে এখানকার ভাং-এর বেশ নাম আছে। সারাবছরই ভাং পাওয়া যায়। আর এখানে জল দিয়ে মিশিয়েও ভাং-এর গুলি খেতে আসেন অনেকে। দোলের সময়টা নাহয় বাদই দিলাম।
শহরের অন্যান্য দোকানের মতো এখানেও ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো। তবে একেবারে দক্ষিণ কলকাতায় এইভাবে ভাং-এর দোকান তেমন চোখে পড়ে না। যা একইসঙ্গে স্থায়ী এবং পুরনো। বালিগঞ্জের কাছে এক দোকান রয়েছে বটে। তাকেই দক্ষিণের প্রসিদ্ধ ভাং-এর দোকান বলা যতে পারে। সবমিলিয়ে শহরের মানচিত্রে এই ক’টা দোকানই ‘বড়দের শরবতের দোকান’ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কিন্তু অচেনা গলিতে অস্থায়ী দোকান রয়েছে আরও। মোটের ওপর উত্তর কলকাতার পাল্লা ভারী সেক্ষেত্রে। বছরের অন্যান্য সময় এ চত্বরের রং যেমনই হোক, দোলের আবহে তার চেহারা বদলাবেই।