ফেক নিয়ে চর্চা প্রতিদিন, কেক নিয়ে বাঙালির বড়দিন। তবে, ‘ফেক’ কেক কি হয় না! তাও হয় বইকি! কেক-এর কুষ্ঠিঠিকুজি জেনে রাখলে অবশ্য সে সমস্যা নেই। সে সবেরই খোঁজ দিচ্ছিলেন শহরের শতাব্দীপ্রাচীন কেকের দোকান ‘ইম্পিরিয়াল’-এর বর্তমান মালিক শেখ পারভেজ।
শুনলেন এবং বুঝলেন শুভদীপ রায়।
ভ্যানিলা? বাটারস্কচ? উঁহু, বোধহয় চকোলেট! কিছুতেই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। অবশ্য হবই বা কী করে! এখানে গন্ধের ককটেল। অন্য সময় হলে আইসক্রিমের কথা মনে হত, কিন্তু শীতকালে ভ্যানিলা-চকোলেটের যোগ্য দোসর একজনই, কেক! বোঝা গেল হাঁটতে হাঁটতে কেকের স্বর্গরাজ্যে হাজির হয়েছি।
জন্মদিন হোক বা ক্রিসমাস, নিউ মার্কেটের শেষ প্রান্তে থাকা বাজারটিই কেকের স্বর্গরাজ্য। পাশাপাশি শতাব্দীপ্রাচীন অনেকগুলো দোকান। সবজায়গায় ভিড় নেই, তবে কেকের গন্ধ রয়েছে। একেবারে হাতে-গরম কেক মিলবে সব দোকানেই। এই চত্বরেই রয়েছে বিখ্যাত নাহুমস। প্রতি বছর এই একটি দোকানে কেক কিনতে লাইন পড়ে। তবে স্রেফ নাহুমস হয়, কেকের রাজ্যে দোকান রয়েছে আরও অনেক। যেমন, বহুকাল ধরে বাঙালির কেকের বাসনা পূরণ করে চলেছে ‘ইম্পিরিয়াল’। ধারে-ভারে এ-দোকান বাঙালির শ্লাঘা বাড়ায়।
হগ মার্কেটের গেট দিয়ে ঢুকলে এ-দোকান চোখে পড়বেই। পুরো নাম অবশ্য আলাদা, ‘ইম্পিরিয়াল বেকারস্ অ্যান্ড কনফেকশনরিস’। শুধু কেক নয়, এখানে নোনতা মুখোরচক বিভিন্ন খাবার পাওয়া যায়। তার মধ্যে মটন প্যাটিস বেশ জনপ্রিয়। দোকানেই ছিলেন বর্তমান মালিক শেখ পারভেজ। অল্প কথায় শোনালেন তাঁর দোকানের ইতিহাস। জানালেন বর্তমানে এই দোকানের মালিকানা ভাগ হয়েছে তিনি ও তাঁর ভাইদের মধ্যে। তবে এককালে এই চত্বরে আর কোনও কেকের দোকান ছিল না। একা কুম্ভ গড় সামলাত ‘ইম্পিরিয়াল’। কথায় কথায় বললেন, তখনকার বড়দিন যাপন অনেকটাই আলাদা ছিল। ঠিক কেমন?
উত্তর দিতে গিয়ে স্মৃতিতে ডুবলেন পারভেজ। তাও বছর বিশ আগেকার কথা তো বটেই! ভিড়ের ছবিটা তখনও প্রায় একইরকম ছিল। তবে দোকানের নয়, মানুষের। বড়দিনের প্রায় এক মাস আগে থেকে এই চত্বরে মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকত। সুন্দরভাবে সাজানো হত চারদিক। সবাই কেক কিনতেন, নিয়ে যেতেন। থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘গরম কেক?’ ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানালেন। অবাক হলাম, তবে কারনটাও নিজেই বললেন পারভেজ। আসলে বিক্রির জন্য এই গরম কেক-এর টোপ দেওয়া হয় আজকাল। আক্ষরিক অর্থে তাতে ভুল নেই। হাতে নিলেও বোঝা যাবে সেই কেক গরম। কিন্তু দোকানের বাক্সে রাখা ঠান্ডা কেকের তুলনার এর মান কিছুটা খারাপ। দামেও খানিক কম। যেহেতু গরম টাটকা কেকের নিজস্ব একটা স্বাদ আছে, তাই একটু কম মানের কেক এইভাবে বিক্রি করা হয়। এই কেক ঠান্ডা হলেই খেতে ভালো লাগবে না তেমন। তাই বলে গরম কেক যে খারাপ তা নয় বরং টাটকা জিনিস। তবে স্বাদ এবং মান দুদিকে ব্যালেন্স করতে হলে ঠান্ডা কেক কেনাই ভালো। দোকানের প্রতিটা কেক যত্ন নিয়ে তৈরি করেন পারভেজরা। বিভিন্ন রকমের কেক উপলব্ধ। তবে কোনওটায় কৃত্রিম গন্ধ বা এসেন্স ব্যবহার করা হয় না। প্রশ্ন করলাম, ‘তাহলে কেক তৈরির কোনও বিশেষ রেসিপি রয়েছে?’
পারভেজ বললেন, আলবাত রয়েছে। এবং সেই রেসিপি খোদ ব্রিটিশদের থেকে পাওয়া। এককালে এই চত্বরে দাপট ছিল হগ সাহেবের। তাঁর বাড়িতে ছোটবেলায় কাজ করতেন শেখ পারভেজ-এর কোনও এক পূর্বপুরুষ। তিনিই ব্রিটিশ সাহেবের বাড়িতে কেক তৈরি শেখেন। একেবারে বিলেতি কায়দায় তৈরি সেই কেক নিজে বানাতে শুরু করেন তিনি। এরপর হগ মার্কেট তৈরি হলে খোদ সাহেব একটি দোকানঘর বানিয়ে দেন। সেই দোকানই আজকের ‘ইম্পিরিয়াল’। নামটাও সাহেবদেরই রাখা। আকারে বহরে এই ক’দিনে অনেকটা বদলেছে দোকানঘর। এখানকার বহু কর্মচারী নিজের মতো করে ব্যবসা শুরু করেছে। ওই চত্বরেই নাকি এমন দোকান রয়েছে। তবে ঐতিহ্যের খাতিরে সবথেকে প্রাচীন এই এই দোকানই। দামের হিসাব বদলেছে আগের তুলনায় অনেকটাই। সেটা অবশ্য বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়েই। তবে কেকের মান পড়তে দেননি বলেই দাবি পারভেজ-এর। কিন্তু আজকাল চারিদিকে এত কেকের দোকান বেড়েছে, সেই ভিড় নিয়ে কোনও অভিযোগ?
একেবারেই না! হেসে হেসেই উত্তর দিলেন, কোনও অভিযোগ নেই। বরং এত বেশি কেকের দোকান হওয়ায় তাদেরই লাভ হয়েছে। পারভেজের কথায়, একসময় মানুষ স্রেফ জন্মদিনে কেক কাটত। আজকাল যে কোনও আনন্দ অনুষ্ঠানের অঙ্গ হয়েছে কেক। তাতে আখেরে লাভ হয়েছে কেক ব্যবসার। তাই আরও বেশি দোকান হলেও আপত্তি থাকবে না তাঁর। স্পষ্ট জানালেন, তাঁরা নিজেদের মতো নিজেদের জায়গায় ঠিক রয়েছেন। আগামীদিনেও এমনটাই বজায় থাকবে মনে করছেন কেকশিল্পী পারভেজ।