দুবছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বজোড়া মানুষকে তটস্থ করে রেখেছে করোনা মহামারী। তবে ইতিহাস জানায়, এই প্রথম নয়। এর আগেও বারবার বিভিন্ন মহামারী আছড়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। তার মধ্যে কোনও কোনওটি প্রাণহানির নিরিখে ভয়ংকর। আবার কোনও কোনও মহামারী যতটা ভয় জাগায়, তার চেয়ে অনেক বেশি আশ্চর্য করে। যেমন ধরুন, এই নাচের মহামারীর কথা। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
মহামারী শব্দটির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ভয়। কোনও ভয়ানক রোগ, তার ফলে মারাত্মক অসুস্থতা, অবশেষে হয়তো মৃত্যুও, এমনটাই মহামারীর চেনা ছক। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল, সব মহামারী ঠিক এই ছকে চলেনি। চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসে এমন একাধিক মহামারীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যার উপসর্গ শুনলে অবাক হতে হয়। কখনও তার লক্ষণ হাসি, কখনও বা নাচ। অবাক হচ্ছেন তো? তাহলে আসুন, শুনে নেওয়া যাক কোরিওম্যানিয়া কিংবা ডান্সিং প্লেগের কথা।
আরও শুনুন: মোটেও হাসির বিষয় নয়… পৃথিবীতে এসেছিল হাসির মহামারীও, মৃত্যুমুখে পড়েছিলেন বহু মানুষ
গ্রিক ভাষায় কোরোস শব্দের মানে নাচ, আর ম্যানিয়া হল উন্মাদনা। এই দুই শব্দ মিলিয়ে একটি বিশেষ মহামারীকে চিহ্নিত করা হয়, কারণ তার লক্ষণ ছিল একটিই। নাচ। সপ্তম শতকে প্রথম এই রোগের সূত্রপাত বলে মনে করা হয়। ১০২০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের বার্নবার্গ শহরের গির্জাতে ক্রিসমাস ইভের প্রার্থনাসভায় ১৮ জন কৃষক আচমকা একসঙ্গে নাচতে শুরু করে। এরও প্রায় দুশো বছর পরে, এইভাবেই অনেক মানুষ একটি ব্রিজের উপর নাচতে শুরু করেন, এবং সেটি শেষমেশ ভেঙে পড়ে। আর শ-পাঁচেক বছর আগে স্ট্রাসবার্গ শহরে এই রোগ মহামারীর রূপ নেয়। মিসেস ট্রফিয়া নামে এক মহিলা হঠাৎই রাস্তায় দাঁড়িয়ে নাচতে শুরু করেন। কিছুতেই থামছিল না সেই নাচ। বিদেশি সমাজে নাচ এমনিতেই বেশ গ্রহণযোগ্য একটি বিষয়, ফলে কেউ কেউ খুশি হয়ে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন। কিন্তু অচিরেই বোঝা গেল, এ নাচ ঠিক স্বাভাবিক নয়। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গিয়েছে। এক সপ্তাহ শেষে দেখা যায় নাচে যোগ দিয়েছে আরও ৩৪ জন মানুষ, আর এক মাস শেষে সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় ৪০০ জনে। প্রায় তিন মাস ধরে চলেছিল এই উন্মাদনা। তাও শুধু একটি শহরে নয় কিংবা মাত্র একবার নয়। ইউরোপে রাইন নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরগুলোতে পুরো চোদ্দ শতক জুড়েই অনেকবার এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা যায়। একটানা নাচের ফলে ক্লান্তিতে অনেকেরই হার্ট অ্যাটাক হত। স্ট্রাসবার্গে কোরিওম্যানিয়া মহামারীতে একসময় একদিনে পনেরোজন মানুষ মারা যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
আরও শুনুন: প্লেগ থেকে স্প্যানিশ ফ্লু, বারেবারে এসেছে মহামারী, লড়াই করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে মানুষ
সেকালের মানুষ ধরে নিয়েছিল, এই মহামারী ঘটছে সেন্ট ভিটাসের অভিশাপের কারণে। কিন্তু সতেরো শতকে বিশেষজ্ঞরা এই রোগের বৈজ্ঞানিক কারণ খুঁজে বের করতে উঠেপড়ে লাগেন। আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা শেষমেশ একে একরকম স্নায়বিক রোগ বলে চিহ্নিত করে। এর নাম দেওয়া হয় ‘সাইডেনহ্যাম’স কোরিয়া’। জানা যায়, এই রোগের জন্য আসলে দায়ী কোনও অভিশাপ নয়, একরকম স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণই এহেন অসংলগ্ন আচরণের কারণ। শিশু এবং মহিলারাই এই রোগের শিকার হয় বেশি। তবে, রোগটির অস্তিত্ব থাকলেও, কোরিয়া মহামারী আপাতত পৃথিবী থেকেই বিদায় নিয়েছে।