‘বাটার চিকেন’ আসলে কার? এই নিয়েই তুমুল ঝগড়া বাঁধে দিল্লির দুই রেস্তরাঁর মধ্যে। ঘটনার জল গড়ায় আদালত অবধি। শেষমেশ কী রায় দেন বিচারপতি? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
এ দেশে মাংস খাওয়ার চল আজকের নয়। কাজেই ভারতীয় রেস্তরাঁয় মাংসের পদও নেহাতই কম নেই। তাতে বাইরের দেশের রান্নার ছাপ থাকতেই পারে। কিন্তু ভারতীয় রাঁধুনিরা এমনভাবে সেইসব পদ তৈরি করেন যা সকলে তারিফ করতে বাধ্য হন। ‘বাটার চিকেন’ও এমনই এক পদ। ভারতীয়রা তো বটেই, গোটা বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ এর প্রেমে হাবুডুবু খান। কিন্তু এই পদ আসলে কার তৈরি, সে নিয়ে আদালতে মামলা অবধি হয়েছিল।
একসময় বাঙালি বাড়িতে চিকেন খাওয়ার চল ছিল না একেবারেই। এখনও সে নিয়ম বেশ কিছু পরবারে মেনে চলা হয়। বাইরে খেতে আপত্তি নেই। কিন্তু ঘরে উঠবে না মুরগির মাংস। অথচ স্বাদে এবং বাজেটে চিকেনের জুড়ি মেলা ভার। রুটি হোক বা ভাত, সঙ্গে একটা লেগপিস থাকলে আর কিছু দরকার পড়ে না। এমনকি বিরিয়ানিতেও মটন অপেক্ষা চিকেন পছন্দ করেন অনেকে। এক্ষেত্রে আলোচনা স্রেফ চিকেন নিয়ে নয়, চিকেনের এক বিশেষ পদ, ‘বাটার চিকেন’ নিয়ে। যে কোনও ভারতীয় রেস্তোরাঁতেই চিকেনের এই বিশেষ পদ মিলতে বাধ্য। দামের ফারাক থাকতেই পারে। স্বাদে তেমন তফাৎ ধরা পড়ে না। যদি না, দিল্লির বাটার চিকেনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। আসলে এই ধরনের খাবারের ক্ষেত্রে দিল্লির রেস্তরাঁর জুড়ি মেলা ভার। কাজেই সেখানকার রান্নার সঙ্গে আর কিছুর তুলনা চলে না। অনেকেই ধরে নেন, বাটার চিকেন জাতীয় খাবারের জন্ম দিল্লিতেই। কিন্তু সেখানেও গন্ডগোল রয়েছে। স্রেফ দিল্লি বললে হবে না। রাজধানীতে হোটেল রেস্তরাঁর ছড়াছড়ি। তার মধ্যে কোন রেস্তরাঁয় প্রথমবার বাটার চিকেন তৈরি হয়েছিল, সেটাই আসল তর্কের বিষয়। শুনতে অবাক লাগলেও, এই তর্কের জলই গড়িয়েছিল আদালত অবধি। যার কেন্দ্রে ছিল দিল্লির দুই বিখ্যাত রেস্তোরাঁ।
ঘটনার সূত্রপাত দেশভাগের সময়। ভারতের বেশ কিছু জায়গা তখন পাকিস্তানের অংশ। অনেকেই নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসছেন নতুন ভারতে বসতি গড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। অনেকে আবার এপার থেকে ওদিকে যাচ্ছেন আত্মীয়ের টানে। ‘বাটার চিকেন’ যুদ্ধের কেন্দ্রে যে দুই রেস্তরাঁ রয়েছে, দুইয়েরই মালিকের নাম কুন্দন। যারা পেশোয়ার থেকে দিল্লি চলা আসেন ব্যবসার উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রথমজন, অর্থাৎ কুন্দন লাল গুজরাল রাজধানীর বুকে মোতি মহল নামে এক রেস্তোরাঁ খোলেন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দিল্লির এই রেস্তরাঁর নাম শোনেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। জনপ্রিয় এই রেস্তরাঁর মালিক কুন্দন গুজরালই দাবি তোলেন বাটার চিকেন আসলে তাঁর আবিস্কার। যোগ্য প্রমাণ হিসেবে আবিস্কারের গল্পও শোনাতেন কুন্দন। বলতেন, ১৯৩০ সালে চিকেনের এই বিখ্যাত পদ তিনি আবিস্কার করেন। আহামরি কিছুই না! আগেরদিন পড়ে থাকা তন্দুরি চিকেন নতুন করে টম্যাটো আর মাখনের গ্রেভিতে মিশিয়ে নিয়েই তৈরি হত ‘বাটার চিকেন’। সঙ্গে আরও কিছু মশলা মেশাতেন কুন্দন। যা বাটার চিকেন-কে করে তুলত স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। এদিকে পেশোয়ার থেকে ভারতে আসা দ্বিতীয় কুন্দন, অর্থাৎ কুন্দন লাল জাগগিও খানিক একইরকম দাবি তোলেন বাটার চিকেন সম্পর্কে। তিনিও দিল্লির আরেক বিখ্যাত রেস্তোরাঁ দারয়াগঞ্জের মালিক। তাঁর দাবি ছিল, বাটার চিকেনের রেসিপি তৈরিতে তাঁর অবদানই সবথেকে বেশি। তাই এই খাবারের স্বত্ব তাঁরই পাওয়া উচিৎ। সময়ের সঙ্গে এই বিবাদ আরও বড় আকার ধারণ করে। ব্যক্তিগত কৃতিত্ব অর্জনের লড়াই হয়ে ওঠে দুই পরিবারের গৌরবের দন্দ্ব। একদিকে গুজরাল পরিবার দাবি জানায়, পেশোয়ার থাকার সময় থেকেই এই রেসিপি তাঁদের পরিবারের অংশ হয়ে উঠেছিল। একইভাবে জাগগি পরিবারের দাবি ছিল, তাঁদের কাছেই আসল বাটার চিকেনের হদিশ মিলবে। এই নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন দুই রেস্তরাঁর মালিকরা। যাবতীয় নথি পেশ কর হয় বিচারকের সামনে। একাধিক সাক্ষীও আদালতে নিজেদের বয়ান শুনিয়ে যান। তবু শেষ পর্যন্ত বাটার চিকেন মামলায় কিছুই রায় দেয়নি আদালত। অর্থাৎ এই খাবারের স্বত্ব নিয়ে হওয়া মামলাটি এখনও অমীমাংসিত রয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার জন্য, বাটার চিকেনের স্বাদের হেরফের হয়নি এতটুকু। আবিস্কর্তা যেই হন না কেন, চিকেন প্রেমীদের কাজ স্রেফ খাওয়া। সেখানে কোনও সমস্যা না হলেই হল।