সুরের গায়ে গায়ে কিছু রং লেগে থাকে। বাতাস কুড়িয়ে নেয়। তুলে রাখে। যা কিছু অশ্রুত, তবু ছিল; কিংবা আসবে। সেই পঞ্চম বেদ। আগামীর রং। মানুষের এক জীবন বেঁচে থাকা। ভুল আর ভোলার ভাগ-ই বেশি। বিস্মরণ গাঢ় হয় বলে কোনও রং পায় না সে তেমন করে। দোয়েলের, জোনাকির কাছে রঙের জীবন চেয়ে ফিরে ফিরে যায় ব্যর্থ মানুষ। রঙের সাধ তার মেটে না। মানুষের বেঁচে থাকা রংচটা তাই; ক্রমশ মলিন হয়ে আসে। লিখলেন সরোজ দরবার। ছবি দীপঙ্কর ভৌমিক।
মাটির গায়ে কে একটু রং ছোঁয়াবে বলুন? গাছেদের সঙ্গে মাটির সখ্য কতদিনের। কত রাধিকা ফুরলো। মাটির বুকের ভিতর তবু পুরনো শিকড়। মরে যাওয়া গাছের স্মৃতি। মাটি মনে রাখে। গাছেরা তাই দু’পাপড়ি ফুল ছড়িয়ে দেয়। বসন্তে। না-বসন্তে। গেরস্থের হাঁড়ির দু’মুঠো অতিরিক্ত ভাতের মতো। যদি অতিথি কেউ চলে আসে! আসে না আজকাল। অতিথি শব্দ অর্থ হারিয়ে অন্ধ। তবু। অভ্যাস। গাছেদেরও। বাঁচিয়ে রাখা কয়েকটা পাপড়ি ওরা ছড়িয়ে দেয় মাটির গায়ে। রিকশার প্যাডেলে সেই দোলের গল্প। প্যাডেল ভাঙার রং চোখে পড়ে না ইদানীং। রিকশার গায়ে ইউনিয়নের রং। সে-রং বদলায়। বদলায় না মাটি, গাছ। মানুষও!
:আরও শুনুন:
বিনা অনুমতিতে মেয়েদের গায়ে রং, তবু কেন ‘বুরা না মানো হোলি হ্যায়’?
স্পর্শ বদলে যায়। মানুষের হাত খরখরে। হাতের উপর হাত রাখলে টের পাওয়া যায় বালি। এত বালি এল কোথা থেকে! বুকের ভিতর মরুভূমি বোধহয়। জল নেই। প্রেম নেই। স্পর্শের রং নেই তাই। ছুঁয়ে থাকা শীতল অভ্যাস। গরম তবু বেড়েই চলে। এত উত্তাপ। চোখ ঝলসায়। চামড়াও। স্পর্শ উত্তাপ ফিরে পায় না। মানুষের বুকের গভীরে মানুষেরই শিকড়। চলে যাওয়া মানুষের। থেকেও অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মানুষের। ভুলে যাওয়া মানুষের। ভুলে যাওয়ার কথা জানে বাই সাইকেল। সরু রাস্তা। মাঠের পাশে ফেলে রাখা স্কুল ব্যাগ। খেলুন্তে বিকেল। সেসবের গায়ে এখনও কিছু রং লেগে। পুরনো হয়ে আসা, ক্ষয়ে যাওয়া স্মৃতির রং। মানুষ দ্রুত রং ভুলে যায়। যেতে চায়। ঘষে ঘষে তুলে ফেলে যাবতীয় উল্লাস। উদযাপন। ভুলে ভুলে যায় কোজাগরীর গায়ে পূর্ণিমা-রং। জেগে থাকার রং তবু উজ্জ্বল থাকে কিছুদিন। আরও কিছুদিন। তারপর রংহীন প্রান্তরের গান একা একা হেঁটে যায় আলপথ ধরে। সুরের গায়ে গায়ে কিছু রং লেগে থাকে। বাতাস কুড়িয়ে নেয়। তুলে রাখে। যা কিছু অশ্রুত, তবু ছিল; কিংবা আসবে। সেই পঞ্চম বেদ। আগামীর রং। মানুষের এক জীবন বেঁচে থাকা। ভুল আর ভোলার ভাগ-ই বেশি। বিস্মরণ গাঢ় হয় বলে কোনও রং পায় না সে তেমন করে। দোয়েলের, জোনাকির কাছে রঙের জীবন চেয়ে ফিরে ফিরে যায় ব্যর্থ মানুষ। রঙের সাধ তার মেটে না। মানুষের বেঁচে থাকা রংচটা তাই; ক্রমশ মলিন হয়ে আসে।
:আরও শুনুন:
কেন দোল উৎসব বলে উদযাপিত হয় ফাল্গুন পূর্ণিমাই?
অথচ বসন্ত আসেই। বেয়াড়া, নাছোড়। রাতবিরেতে কে যেন চাদ্দিকে টাঙিয়ে দেয় রঙিন শামিয়ানা। শবের উপর। বেঁচে থাকা সব শব। রং তবে অভ্যাস মাত্র! চোখের দেখা। রঙের তো স্পর্শ নেই। অন্ধের কাছে সে তবে কোন অনুবাদে ধরা দেবে! দেখেও দেখে না যে। স্বেচ্ছা দৃষ্টিহীন শুধু রামধনু আঁকে। সাত তার রং-নাম্বার। রঙের গায়ে রং। রং মিলেমিশে দল, দলের বদল। রংকে সে বেগার খাটায়। ভুল বুঝিয়ে রঙের গা থেকে ঝরিয়ে দেয় যাবতীয় উচ্ছ্বাস। ফলত পড়ে থাকে অন্ধকার। অন্ধকারের রং নিয়ে হেঁটে যাওয়া ভোরের রং অব্দি। সে বড় দীর্ঘ পথ। মানুষ থেকে মানবের। এক আধবার তবু মানুষ ঝেড়ে ফেলে হাতের বালি। হাতের উপর রাখে হাত। স্পর্শের রং ফোটে বসন্তের অকালবোধনে। সে রঙের নিশান ওড়ে দিকে দিকে। না-ই বা তাহার অর্থ হোক, না-ই বা বুঝুক বেবাক লোক। রং-ওঠা এক জীবনে এক-আধবারই এ-রঙের দেখা পায় মানুষ। সেদিন সে চেয়ে ফেলে রঙের অধিকার। রং তার চেতনার। রঞ্জন। যক্ষপুরীর ভিতরে সেদিন দারুণ আন্দোলন।
:আরও শুনুন:
হোলির রং লাগে গোটা দেশেই, কোথায় কীভাবে হয় উদযাপন?
অথচ সব রং মেলে না। চেয়ে চেয়ে ফিরেও যেতে হয়। কষ্টে পাওয়া রংটুকুও গলে যায় আঙুলের ফাঁক দিয়ে। শুধু জেগে থাকে, অনেক মানুষের এক হয়ে কিছু চাওয়া। একান্তে চাওয়া। মানুষের বুকের মাটিতে মানুষেরই শিকড়। মানুষ, বিস্মরণের নুন খাওয়া মানুষ, তবু একেবারে ভুলতে পারে না সবটুকু। একটু রং তাই ছড়িয়ে দিতে চায় মাটিতে, স্মৃতিতে। যে-রং তার এক জীবনের অর্জন। এক জীবনের ব্যর্থতাও।
যে চলে যায়, চলে গেছে, যার জন্য চেয়ে চেয়ে পাওয়া যায়নি কিছু, ভোরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ অস্ফুটে তাকেই যেন শুধু বলতে পারে, না-পাওয়ার রং নাও তুমি…