ন্যায় বিচারের দাবিতে আন্দোলন। শুধু মানুষ নয়, করতে হয় দেবতাদেরও। তাতে সাধারণ মানুষের শামিল হওয়ার উপায় নেই, তাই যোগ দেন মুনি-ঋষিরা। এমনই এক আন্দোলন করতে হয়েছিল স্বর্গের চিকিৎসকদের। ঠিক কী দাবি ছিল তাঁদের? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
অনুরোধে হয়নি সুরাহা। উপায় একটাই, আন্দোলন। একদিনে না হোক, একদিন হবেই। এই বিশ্বাসে পথে নামা। তখন আর সাধারণ তকমা নেই, নতুন পরিচয় ‘আন্দোলনকারী’। মানুষের পৃথিবীতে এমনটা নতুন কিছু নয়। ন্যায় বিচারের দাবিতে হামেশাই পথে নামতে হয় অনেককে। তাই বলে স্বর্গেও আন্দোলন হয়? পুরাণ বলছে এমন কাহিনিও রয়েছে। তাও আবার স্বর্গের চিকিৎসকদের আন্দোলনের কাহিনি।
পুরাণ মতে স্বর্গের প্রধান চিকিৎসক দুজন। তাঁরা অশ্বিনীকুমারদ্বয় হিসেবে পরিচিত। এঁদের জন্ম বৃন্তান্ত নিয়ে নানা ব্যাখ্যা মেলে। অনেকে ধন্বন্তরি হিসেবেও এঁদেরই কথা বলেন। হেন কোনও রোগ নেই যার চিকিৎসা এঁরা জানেন না। মৃত্যুর মুখ থেকে রোগীকে ফিরিয়ে আনতে পারেন এই দুই চিকিৎসক। মহাভারতেও এঁদের উল্লেখ রয়েছে। নকুল ও সহদেবের জন্ম এই অশ্বিনীকুমারদের বরেই হয়েছিল। তবে এই দুই চিকিৎসককেই একবার আন্দোলন করতে হয়েছিল স্বর্গলোকে। দাবি ছিল সমান অধিকারের। যা অন্যান্য দেবতারা ভোগ করতেন, কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশে সুযোগ পেতেন না অশ্বিনীকুমাররা। যদিও সেই আন্দোলন কোনও বিদ্রোহ ছিল না। বরং নিজেদের যোগ্যতা দিয়েই অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছিলেন অশ্বিনী ভাতৃদ্বয়।
সে যুগে মুনি ঋষিরা ক্ষমতায় দেবতাদের চাইতে কিছুমাত্র কম ছিলেন না। ধ্যানের বলে তাঁরাও অনেক কিছু করতে পারতেন। এই ঘটনার সঙ্গেও এমনই এক মুনির ভূমিকা জড়িয়ে। তিনি হলেন চ্যবন মুনি। মহামায়া ভগবতীর উপাসক এই মুনি ছিলেন অন্ধ। তাঁর স্ত্রী ছিলেন অপরূপ সুন্দরী এক রাজকন্যা। স্বামী মুনি হলেও, বৃদ্ধ এবং অন্ধ। সেই নিয়ে দুঃখ ছিল রাজকন্যার। তবে মুখ ফুটে বলতেন না। পাছে মুনি রাগ করেন। কিন্তু রাজকন্যার দুঃখ বুঝতে পারেন অশ্বিনীদ্বয়। তাঁরা হাজির হন মুনির আশ্রমে। চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন চ্যবন মুনিকে। চোখের দৃষ্টি ফিরে পান মুনি। সেইসঙ্গে আগের মতো যৌবন ফিরে পান। স্বামীর রূপ দেখে রাজকন্যা তো অবাক। স্বয়ং মুনি চ্যবনও বেজায় খুশি। তখনই বললেন, স্বর্গের দেবতাদের মতো সমান অধিকার পাবেন অশ্বিনীদ্বয়। অধিকার বলতে, সোমরস পানের অধিকার। যা স্বর্গের চিকিৎসকদের ছিল না। স্রেফ প্রমোদের জন্য নয়, স্বর্গে বসে সোমরস পান দেবতাদের কাছে অহংকারের বিষয় ছিল। কিন্তু সেই অহংকার দেখানোর সুযোগ পেতেন না অশ্বিনীরা। এদিকে দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করার ক্ষমতা ছিল না তাঁদের। প্রথমবার মুনি চ্যবনের কথা শুনে সাহস পেলেন তাঁরা। ঠিক করলেন, সোমরস পান করবেন। কিন্তু মুনির আশ্রমে সোমরস নেই। এইসময় সেখানে উপস্থিত হন রাজা শর্যাতি। তিনি রাজকন্যা সুকন্যার পিতা। তথা চ্যবন মুনির শ্বশুর। প্রথমে তিনিও মুনিকে দেখে বেজায় চমকে যান। পরে সবটা শুনে অশ্বিনীদ্বয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। এই রাজাই প্রতিশ্রুতি দেন, রাজসূয় যজ্ঞ করার। ঠিক হয়, সেখানেই অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে সোমরস পান করবেন অশ্বিনীদ্বয়। নির্দিষ্ট দিনে সব আয়জন হয়। দেবতারাও উপস্থিত হন রাজার আমন্ত্রণে। এতদিনে এই ধরনের অনুষ্ঠানে থাকার সুযোগ পেতেন না অশ্বিনীরা। তবে সেদিনের যজ্ঞে তাঁরাই ছিলেন প্রধান অতিথি। যজ্ঞ শেষে তাঁদের হাতে সোমরস তুলে দেন ঋষি চ্যবন। এই দৃশ্য দেখে বেজায় চটে যান ইন্দ্র। তাঁর নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে সোমরস পান করবেন স্বর্গের চিকিৎসক? হতেই পারে না! প্রথমে মানা করলেন। তাতে কাজ না হওয়ায় বজ্রকে আহ্বান জানালেন ইন্দ্র। এদিকে অশ্বিনীরাও সোমরস পানে অনড়। এইসময় মুনি চ্যবন যোগবলে এক অসুরের সৃষ্টি করেন। সেই অসুরের ক্ষমতা এতই যে একা ইন্দ্রের পক্ষে সামলানো সহজ ছিল না। ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হয় যজ্ঞস্থলে। বেগতিক বুঝে গুরু বৃহস্পতিকে স্মরণ করলেন ইন্দ্র। যোগবলে দেবগুরু বুঝলেন, চ্যবন এমন এক অসুরের সৃষ্টি করেছে যাকে হারানোর ক্ষমতা কোনও দেবতার নেই। কাজেই চ্যবনের কথ না শুনে উপায় নেই। দেবরাজ কথা দিলেন, স্বর্গের অন্যান্য দেবতার মতো অশ্বিনীরাও সোমরস পানের অধিকার পাবেন। এরপরই অসুরকে শান্ত করে পরিস্থিতি শান্ত করেন চ্যবন। পুরাণের এই কাহিনিই ন্যায় অধিকারের কথা বলে। স্রেফ মানুষ নয়, অধিকার ছিনিয়ে নিতে দেবতাদেরও যে আন্দোলন করতে হয়েছিল, সে কথাই প্রমাণ দেয় এই ঘটনা।