বছরের বাকি অমাবস্যায় চারপাশ আঁধারে ডুবে থাকলেও, কার্তিকের অমাবস্যায় আলো যেন উপচে পড়ে। চতুর্দশী উপলক্ষে চোদ্দ প্রদীপ দেওয়া হয়। কথা হচ্ছে, আঁধার ও আলো বিপ্রতীপ হলেও কী করে তাদের মহামিলন ঘটল এই তিথিতে? এই রীতি কি বাংলার নিজস্ব? লিখছেন সৌভিক রায়।
একমাত্র আলোই পারে তমসা ঘোচাতে। আবহমান কাল থেকে প্রদীপ ব্যবহৃত হয়ে আসছে আলোক উৎস হিসেবে। পল্লিবাংলার পিদিম আর পিলসুজ বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। প্রতি সন্ধ্যায় তুলসীতলায় প্রদীপ দেওয়া বাংলার নিজস্ব এক রীতি। আর কার্তিকের অমাবস্যার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল প্রদীপ। কিন্তু দীপান্বিতা অমাবস্যায় প্রদীপ জ্বালানোর নেপথ্যে রয়েছে কোন কারণ?
আরও শুনুন: বসন পরো মা… মাতৃস্বরূপা কালী কেন নগ্নিকা?
উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে দেখা যায় মানবজাতির সঙ্গে আগুনের সম্পর্কের দিকে। অগ্নি পঞ্চভূতের অন্যতম একটি উপাদান। আদিম মানুষ আগুন জ্বালতে শেখার পর সভ্যতা এগিয়েছে। আগুনকে আদিম মানুষ নিজের রক্ষক হিসেবেই দেখেছিল, সেখান থেকেই ঈশ্বরত্ব পায় আগুন। তারপর যখন ঈশ্বর সাকার হলেন, তখন তার অর্ঘ্যের উপাদান হয়ে উঠল আগুন। কখনও সে হয়ে উঠল যজ্ঞের অগ্নি। আবার কখনও দীপের স্নিগ্ধ আগুন। একশো আটটি হোক বা পাঁচটি, প্রদীপের আরতি ছাড়া যে কোনও পুজোই অসম্পূর্ণ। জন্ম থেকে মৃত্যু সবেতেই জড়িয়ে গিয়েছে প্রদীপ। জন্মের পর ছয় ষষ্ঠীর দিন নবজাতকের মাথার সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়। কারণ বিধাতাপুরুষ তার ভাগ্য লিখতে আসবেন। জন্মদিনে বাড়ির বড়রা প্রদীপের ওম দিয়ে আশীর্বাদ করেন। ঈশ্বরের আরতির পরও প্রদীপ থেকে এমন ওম নেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। সন্তানের মঙ্গলার্থে নীলের ঘরে বাতি জ্বালেন মায়েরা। কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীর কৃপা পেতে সারারাত প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়। শ্রাদ্ধে পূর্বপুরুষকে ষোড়শ দান করে উত্তরসূরিরা, তার মধ্যে একটি দান; দীপ দান। ভাগীরথীতে প্রদীপ ভাসিয়ে উৎসব পালন করত সুবে বাংলা, আজও মুর্শিদাবাদে বেরা পালিত হয়।
আরও শুনুন: লজ্জায় জিভ কাটা নাকি অন্য কিছু! কেন লোলজিহ্বা মা কালী?
গোটা কার্তিক মাস জুড়ে আকাশপ্রদীপ দেওয়া হয় পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে। কুল কুলতি ব্রতের আচারে প্রদীপ দেওয়া হয়, কুল অর্থাৎ পরিবারের মঙ্গল কামনায়। কার্তিকে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে চোদ্দ প্রদীপ দেওয়া হয়। এর কারণ হিসেবে নানান মত রয়েছে। বহুল প্রচলিত মত হল, পিতৃপুরুষের উদ্দেশে এই প্রদীপ দেওয়া হয়। এদিকে কালী পুজোর আরেক নাম দীপাবলি আর অমাবস্যাটির নাম দীপান্বিতা। শব্দের ব্যুৎপত্তি খুঁজতে গেলেই দেখা যায় দুটোতেই দীপ রয়েছে। উৎসবের নামেই দীপ, সেখানে যে প্রদীপ দেওয়া হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু শুধুই কি পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে দীপ দান?
হেমন্ত ঋতু বদলের সময়। এই সময় পোকামাকড়ের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। তা থেকে রেহাই পেতেই আলো জ্বালা হয়। এমনকি কালীপুজোয় যে বাজি পোড়ানো হয় তারও কারণ কীটপতঙ্গ দমন। বাজি পোড়ানো হত আলোক উৎস হিসেবে, শব্দবাজি অনেক পরে এসেছে। বাজির ধোঁয়ায় ও আলোতে কীট দমন হত। আশ্বিন সংক্রান্তিকে নল সংক্রান্তি বলা হয়, সেদিন কৃষি জমিতে নল বাঁধা হয়। উদ্দেশ্য ধানের ফসল রক্ষা করা। ওই সময় থেকে পোকার উৎপাত বাড়ে, দীপান্বিতা অমাবস্যা অবধি পোকামাকড়ের দাপট চলে। লক্ষ করলেই দেখা যায় কালীপুজোর পর থেকেই শ্যামা পোকার উৎপাত কমতে আরম্ভ করে। গ্রামবাংলার বিভিন্ন জায়গায় শুকনো পাতা জড়ো করেও পোড়ানো হয় ভূতচতুর্দশীতে, তার উদ্দেশ্যও পোকামাকড় দমন। প্রাচীন বাংলার সেই পোকা দমনের পদ্ধতিই কালে কালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে হয়তো দীপ দানের রীতি-রেওয়াজে পরিণত হয়েছে, এমনটা মনে করা যেতেই পারে।