কনকনে ঠাণ্ডা। চাদর-সোয়েটার ছাড়া বাইরে বেরোনোর জো নেই। অথচ পাড়ায় পুজো হচ্ছে। ঘটা করে। গান বাজছে, ভোগ বিতরণও চলছে। নিশ্চয়ই ভাবছেন, পৌষকালীর কথা বলছি? কিন্তু না, পুজো হচ্ছে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার। কোথায় হয় এমন পুজো? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
অকালবোধন শব্দটা দেবী দুর্গার সঙ্গেই যায়। কিন্তু ব্যতিক্রম রয়েছে। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাই সে ব্যতিক্রমের মূলে। বাংলার এমন কিছু গ্রাম রয়েছে, যেখানে অসময়ে বিশ্বকর্মার পুজো আয়োজন করা হয়। ভরা শীতকালে , কনকনে ঠান্ডায়। একটা নয়, একাধিক পুজো হয়। রীতিমতো জাঁকজমক করে সেই পুজোর আয়োজন করেন গ্রামের মানুষ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এমনটা হয় কোথায়?
বছরের পর বছর ধরে এই পুজো করে আসছেন বাংলার তন্তুবায় সম্প্রদায়ের মানুষজন। তাঁত বুনেই তাঁদের সংসার চলে। শাড়ি, গামছা, রুমাল সবই তাঁত যন্ত্রে প্রস্তুত করেন তাঁরা। বর্তমানে এই পেশার মানুষ কমলেও, পুরপুরি হারিয়ে যায়নি। শান্তিপুর, বেগমপুর সহ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তাঁতিরা রয়েছেন। এঁরাই শীতকালে বিশ্বকর্মার আরাধনায় মেতে ওঠেন। দুর্গাপুজোর মতো জাঁকজমক দেখা যায় বেগমপুরের অকাল বিশ্বকর্মা পুজোয়। একাধিক মণ্ডপ আর চোখ ধাঁধানো আলোর কাজ তাকিয়ে দেখার মতো। বাইরে থেকেও অনেকে ভিড় জমান পুজো দেখতে। পুজোর ইতিহাসও বেশ মজার। এককথায় বললে, সময়ের অভাবে বিশ্বকর্মার পুজোর দিনক্ষণ বদলে দেন বাংলার তাঁতিরা। আসলে, বিশ্বকর্মা পুজো হয় দুর্গাপুজোর ঠিক আগে আগে। তখন তাঁতিদের কাজের চাপ তুঙ্গে। কাজেই ঘটা করে বিশ্বকর্মা পুজো করা কঠিন। এদিকে তাঁদেরও যন্ত্র নিয়েই কারবার। বিশ্বকর্মার আশির্বাদ তাঁদেরও চাই। তাই প্রায় ৭০-৭৫ বছর আগে, হুগলি জেলার চন্ডীতলার বেগমপুর এলাকার দুই তাঁতশিল্পী ঠিক করেন যখন কাজের চাপ কমবে তুখনই পুজো করবেন। সেইমতো নিজেরাই প্রতিমা গড়ে পৌষ মাসের শুক্ল পক্ষের নবমী তিথিতে বিশ্বকর্মার পুজো শুরু করেন। সেই থেকে পুজো চলে আসছে। ধীরে ধীরে সংখ্যা বেড়েছে। এখন তো চারদিন ধরে পুজোর উৎসব চলে, মেলাও বসে।
এখানকার বিশ্বকর্মা মূর্তির আকারও খানিক আলাদা। হাতির বদলে দেবশিল্পির বাহন এখানে ঘোড়া। তার নেপথ্যেও ব্যাখ্যা রয়েছে। আসলে, তাঁত যন্ত্র থেকে যে শব্দ বেরোয়, তার সঙ্গে ঘোড়ার দৌড়ের বেশ মিল রয়েছে। সেই হিসাবেই দেবশিল্পীর বাহন হিসেবে ঘোড়াকে রাখা হয়। একের বদলে কয়েকটা ঘোড়াও থাকে মূর্তিতে। থিমের বহরও দেখা যায় হালের মূর্তিতে। তবে আর কিছু তেমন আলাদা নেই। এই বিশ্বকর্মাও চতুর্ভুজ। অস্ত্রও সেই এক। হুগলির পাশাপাশি বাঁকুড়ার গোপীনাথপুরের তন্তুবায় সম্প্রদায় এবং নদীয়ার শান্তিপুর ও ফুলিয়ার তাঁতিরাও শীতকালেই বিশ্বকর্মা পুজো করেন। তবে জাঁকজমকের জন্য বেগমপুরের নামই বিখ্যাত।