রথে চড়ে মাসির বাড়ি যাবেন মহাপ্রভু। লোকে লোকারণ্য পথঘাট। সেই ভিড়ে হিন্দু-মুসলিম-শিখ-জৈন, সবাই রয়েছেন। রথের রশিতে টান দিচ্ছেন সকলে। তবে বাংলার এই রথযাত্রা শুরু হয় এক মুসলিম ভক্তের বাড়ি থেকেই। কোথায় জানেন? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
ভক্তের পরিচয় ভক্তিতে। মহাপ্রভুর সামনে কোনও ধর্মের ভেদ নেই। রথের রশি ছোঁয়ার অধিকারও রয়েছে সকলেরই। তবে বাংলার এই রথযাত্রায় ধরা পড়ে সম্প্রীতির অনন্য নজির। এখানে মহাপ্রভুর পরিক্রমা আরম্ভ হয় মুসলিম ভক্তের বাড়ি থেকে। তারপর সকলে মিলে প্রভুকে নিয়ে চলেন মাসির বাড়ির উদ্দেশে।
আরও শুনুন: রথযাত্রায় জাতপাতের ভেদ, তবে রথ চলে সব জাতের হাতের টানেই, বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
রথস্থ বামনং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে’ – অর্থাৎ, রথে উপবিষ্ট জগন্নাথদেবকে যিনি দর্শন করেন, তাঁর পুনর্জন্মের ভাবনা থাকে না। ঠিক সেই টানেই যে এত মানুষ রথের উন্মাদনায় নিজেকে ভাসিয়ে দেন একথা বলা ভুল। বরং বলা যেতে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে মানুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার যোগসূত্র এই রথযাত্রা উৎসব। যার নিমিত্ত স্বয়ং জগন্নাথ। স্রেফ পুরীধাম নয়, বাংলা সহ দেশবিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে মহাসমারোহে পালিত হয় রথযাত্রা উৎসব। বাংলায় মাহেশের রথ সবথেকে প্রাচীন এবং জনপ্রিয়। এছাড়া রাজ্যের বিভিন্ন জগন্নাথ মন্দিরে রথযাত্রা উপলক্ষে উৎসবের আয়োজন করা হয়। অনেকের গৃহমন্দিরেও জগন্নাথ প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা নিজেদের মতো করে ঘরোয়া ভাবেই আয়োজন করেন রথযাত্রার। গুন্ডিচা মন্দির হিসেবে প্রতিবেশী কারও বাড়িতে জগন্নাথকে পৌঁছে দেওয়া হয়। সপ্তাহভর সেখানেই চলে মহাপ্রভুর আরাধনা। হাওড়ার কদমতলা অঞ্চলেও এমনই এক বাড়িতে আয়োজন করা হয় রথযাত্রার। তবে এর বিশেষত্ব এই যে, প্রভুর পরিক্রমা শুরু করেন স্থানীয় এক মুসলিম অধ্যাপকের বাড়ি থেকে। বছরের পর বছর ধরে হাওড়ার এই অঞ্চলে প্রভুর পরিক্রমা শুরু হয় শেখ মকবুল ইসলামের বাড়ি থেকে। স্রেফ তিনি একা নন, এই উৎসবে শামিল হন আরও অনেক মুসলিম ভক্ত। যদিও জগন্নাথের সামনে তাঁদের আলাদা কোনও ধর্ম পরিচয় নেই। প্রভুর ভক্ত হিসেবেই উৎসবে যোগ দেন সকলে।
আরও শুনুন: রথের সঙ্গে যোগ রয়েছে স্বর্গদ্বারেরও, নেপথ্যে কী কাহিনি জানেন?
পেশায় অধ্যাপক মকবুল, ছোট থেকেই জগন্নাথের ভক্ত। পাড়ায় রথ নিয়ে যে উন্মাদনা চলত তাতে শামিল হতেন। বাড়ি থেকেও তাঁকে কখনও বাধা দেওয়া হয়নি। সেকালে অবশ্য রথের জৌলুস অন্যরকম ছিল। রথের মালের আকর্ষণ ছিল আরও বেশি। বিশেষ করে ছোটদের এই মেলার প্রতি টান ছিল মারাত্মক। শহরে আজকাল মেলা হয় না বললেই চলে। কিন্তু রথ নিয়ে উন্মাদনা এখনও কমেনি এতটুকু। তাই নিজেকে উৎসব থেকে আলাদা করে রাখেননি মকবুল। তাঁর বাড়ি থেকেই শুরু হয় জগন্নাথের পরিক্রমা। এখানে অবশ্য আলাদা কোনও রথ নেই। ত্রিমূর্তিকে কোলে করেই মাসির বাড়ি নিয়ে যান ভক্তরা। বাড়িটি অবশ্য প্রতিবেশী দিনেশ কুমার খানের। সেখানেই সপ্তাহভর পূজিত হন জগন্নাথ। দেশজুড়ে রথযাত্রা নিয়ে উন্মাদনা চললেও, হাওড়ার এই অঞ্চলে যে সম্প্রীতির ছবি ধরা পড়ে, তা অবশ্যই নজিরবিহীন বলা যায়।