কোনও নারীকে গালি দিতে হলে ‘ডাইনি’ বলে সম্বোধন করা হয় অনায়াসেই। এমনকি কোনও নারীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক স্লোগানেও ‘ডাইনি’ শব্দের প্রয়োগ দেখা যায় হামেশাই। কিন্তু ‘ডাইনি’ মানে কি সত্যিই ভয়ংকর কিংবা খারাপ কোনও নারী? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
একেবারে পারিবারিক পরিসর থেকে রাজনীতির দুনিয়া, বয়স্কা কোনও নারীর প্রতি ঘৃণা উগরে দিতে সহজেই ‘ডাইনি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এই অভিধার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে তীব্র বিতৃষ্ণা। কিন্তু আদতে কি ডাইনি মানে সত্যিই এমন কোনও মন্দ মেয়ে, যার এতখানি ঘৃণাই পাওয়ার কথা ছিল?
মনে করা যাক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সেই ‘ডাইনী’ গল্পের কথা। গ্রামের একটেরে থেকে যাওয়া এক বৃদ্ধা, সকলে যাকে ডাইনি বলে ভয় করে চলে। যৌবন থেকেই কয়েকটি কাকতালীয় ঘটনা এই তকমা লাগিয়ে দিয়েছে তার গায়ে। লোকের বিশ্বাস, সে অনায়াসে কারও প্রাণ নিতে পারে, কারও রক্ত শুষে নিতে পারে নিঃশেষে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’-তেও আতুরী ডাইনিকে ঘিরে জারি ছিল এমনই ঘৃণা। বাস্তব সমাজেও যে সে ঘৃণা এখনও দূর হয়নি, মাঝে মাঝেই কোনও কোনও খবর তার প্রমাণ দেয়।
অথচ ভারতবর্ষের প্রাচীন পুথিপত্র কিন্তু আদৌ সে কথা বলছে না। ‘ডাইনি’ শব্দের উৎসে রয়েছে ‘ডাকিনী’ শব্দটি। সবচেয়ে প্রাচীন বাংলা বই চর্যাপদ এবং আরও কয়েকটি বৌদ্ধ তান্ত্রিক পুথি খুঁজে পাওয়ার পর পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই পুথি সম্পাদনা করেন, একইসঙ্গে প্রকাশ করেন ‘ডাকের বচন’। সেই বইও আসলে বৌদ্ধ তন্ত্র ধর্মাচরণের সঙ্গেই জড়িয়ে। বৌদ্ধ তান্ত্রিকসমাজে ডাকিনীরা ছিলেন সম্মাননীয়া। চুরাশি সিদ্ধর কাহিনীতে তাঁদের সিদ্ধসাধিকা ও গুরু, দুটি ভূমিকাতেই একাধিকবার দেখা গেছে। আসলে, রহস্যময় গুপ্তবিদ্যার অধিকারী প্রাজ্ঞ মানব-মানবীরাই এককালে ‘ডাক’ ও ‘ডাকিনী’ নামে পরিচিতি পেতেন। ডাকিনী এসেছে ‘ডাক’ কথাটি থেকে। ডাকের অর্থ হল জ্ঞান। অর্থাৎ ডাকিনী বা ডাক হলেন সিদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী, অর্থাৎ প্রাজ্ঞ। তন্ত্রমার্গে শরীরমধ্যস্থ মূলাধার চক্র, যেখানে কুলকুণ্ডলিনী শক্তি সুপ্ত অবস্থায় থাকেন, সেই চক্রে অধিষ্ঠান করেন ডাকিনী শক্তি। আবার, মহাবিদ্যা ছিন্নমস্তার দুই পার্শ্বে থাকেন তাঁর দুই সহচরী ডাকিনী ও বর্ণিনী। ডাকিনীগণ শিব-শক্তির লীলাসহচরী বিশেষ একটি গোষ্ঠীও বটে। পুরাণে বিভিন্ন যুদ্ধের বিবরণে ডাকিনীগোষ্ঠীকে শিব ও শক্তির সেনাদলে দেখা গেছে। বাংলার মঙ্গলকাব্যেও দেখতে পাই তাঁদের। অন্নদামঙ্গলে দক্ষযজ্ঞনাশে শিবের সেনাদলে ডাকিনী যোগিনীদের দেখা মেলে, চণ্ডীমঙ্গলে কলিঙ্গরাজ এবং সিংহলরাজের বিরুদ্ধে চণ্ডী যখন যুদ্ধযাত্রা করেন, তখন অজস্র ভূত প্রেত পিশাচের সঙ্গে ডাকিনী-যোগিনীরাও তাঁর সঙ্গিনী হয়।
আসলে গুপ্তবিদ্যা, যা সাধারণ জনতার জ্ঞানের পরিধির বাইরে। তা দেখে বরাবরই জনতা ভয় পেয়েছে। আর তার ফলেই তৈরি হয়েছে জনতার ক্ষোভ আর রোষ। মুকুন্দ চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলে দেখা যায়, ধনপতির বাণিজ্যযাত্রার আগে তার কনিষ্ঠা পত্নী খুল্লনা স্বামীর মঙ্গলকামনায় চণ্ডীপূজা করছে দেখে সতিন লহনার নালিশ, “তোমার মোহিনী বালা/ শিক্ষা করে ডাইন কলা/ নিত্য পূজে ডাকিনী দেবতা।” চৈতন্যভাগবত-ও বলে, বালকপুত্র নিমাইয়ের উপরে যাতে ডাকিনী যোগিনীর কুনজর না পড়ে, সেজন্য গৃহদেবতা বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা করছেন জগন্নাথ মিশ্র। মধ্যযুগে তো বটেই, আধুনিক যুগেও ভারতের নানা প্রান্তে কত নারী যে ডাইনি সন্দেহে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন, নিহত হন, তার সমস্ত খবর আমরা জানতেও পারি না। না-জানার অন্ধকারেই লুকিয়ে রয়েছে ডাইনি তকমা ঘিরে প্রচলিত যাবতীয় অন্ধবিশ্বাস।