কানওয়ার যাত্রা ঘিরে উসকে উঠেছে জাতপাতের দ্বন্দ্ব। অথচ হিন্দু তীর্থযাত্রীরা যে কানওয়ার বা বাঁক নিয়ে পথে হাঁটছেন, তা তৈরি করেন মুসলিমরাই। সবরকম ভেদাভেদ পেরিয়ে সমন্বয়ের বার্তাই যে এ দেশের আত্মায় লেগে রয়েছে, তা যেন আরও একবার স্পষ্ট হয়ে যায় এই ছবিতে।
হিন্দুদের পুণ্য ব্রত কানওয়ার যাত্রা। সেই তীর্থযাত্রীদের শুচিতা রক্ষার জন্য সম্প্রতি তৎপর হয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও। সেখান থেকে হিন্দু-মুসলিম সংক্রান্ত বিতর্কও উঠে এসেছিল। অথচ, এই যাত্রার সঙ্গেই নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছেন মুসলিমরাও। তাঁদের তৈরি কানওয়ার, অর্থাৎ বাঁক কাঁধেই পথে নামেন ভক্তরা। সবরকম ভেদাভেদ পেরিয়ে সমন্বয়ের বার্তাই যে এ দেশের আত্মায় লেগে রয়েছে, তা যেন আরও একবার স্পষ্ট হয়ে যায় এই ছবিতে।
শ্রাবণ মাস পড়তেই কানওয়ার যাত্রা শুরু। দেশের বিভিন্ন শিব মন্দিরে দলে দলে হাজির হচ্ছেন ভক্তরা। এই আবহেই যোগীরাজ্যে জারি হয়েছিল নয়া নিয়ম। প্রশাসনের নির্দেশে সমস্ত দোকানের বাইরে লিখতে বলা হয় মালিকের নাম। জল্পনা ছিল, আসলে মুসলিম ব্যবসায়ীদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ্যে আনতেই এহেন নির্দেশ। আরও এক ধাপ এগিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন, তীর্থযাত্রীদের পবিত্রতা রক্ষার উদ্দেশ্যেই এই সিদ্ধান্ত। অথচ, এই যাত্রার সঙ্গে মুসলিমদের যোগ যে আরও নানাভাবে রয়েই গিয়েছে, সে কথাও তো অস্বীকার করার নয়। জানা যায়, কানওয়ার যাত্রীরা যে বাঁক নিয়ে হাঁটেন, সাধারণত তা তৈরি করে থাকেন মুসলিম কারিগররাই। যাত্রার শুরুর কয়েক মাস আগে থেকেই এই কাজ শুরু করে দেন তাঁরা। মূলত হরিদ্বারেই এই সম্প্রীতির বন্ধন দেখা যায়। শিবভক্তদের বেশিরভাগই কুম্ভনগর থেকে বাঁক নিয়ে আসেন। আর সেখানেই মুসলিম কারিগররা দিনরাত এক করে বাঁক তৈরি করেন। দীর্ঘদিন ধরে এই কাজই করে আসছেন কুম্ভনগরের ওই মুসলিম কারিগররা। স্রেফ বাঁক তৈরি নয়, বিভিন্ন ভাবে তা সাজানোতেও এঁরা বেশ পটু। কোথাও বাঁকের উপর শিবলিঙ্গ, কোথাও আবার বড় কোনও মূর্তি, বিভিন্ন বাহারি জিনিস দিয়ে সাজানো হয় বাঁক। সেইমতো ঠিক হয় দাম। ভক্তরাও দলে দলে হাজির হন সেসব কিনতে। মনের মতো বাঁক পেলেই খুশি হয়ে টাকা মিটিয়ে চলে যান ভক্তরা। কে সেই বাঁক তৈরি করেছেন, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কথাও ভাবেন না কেউই।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আপাতত স্থগিত হিন্দু মুসলিম ব্যবসায়ীদের নাম পরিচয় লেখার ওই নিয়ম। এমনিতেও, ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশই বলছিলেন, তাঁদের ভাই ডেকে, তাঁদের দোকানে চা খেয়ে যান কিংবা তাঁদের দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যান অনেক যাত্রীই। বরাবর। আসলে এই সমন্বয়ের বার্তাই তো দেয় ধর্ম। ধর্মের মূল কথা তো ধারণ করা। এ দেশের আত্মায় সে কথাই জেগে থাকে। কানওয়ার যাত্রা ঘিরে রাজনৈতিক নির্দেশ যদি জাতপাতের টানাপোড়েন ঘনিয়ে তোলেও, সেই ভেদের উপরে সমন্বয়ের বার্তাকে আরও একবার স্পষ্ট করে দিলেন এ দেশের সাধারণ মানুষেরাই।