শীতে বেড়াতে যেতে কে না চায়! আর এই দলে পিছিয়ে নেই পাখিরাও। পিছিয়ে তো নেই-ই, বরং পাল্লা দিয়ে এগিয়ে আছে অনেকের থেকেই। তাই, ঘুরতে আসার ঠিকানা হিসেবে তারা বেছে নেয় এই বাংলা তথা দেশের মাটিকেই। শীত পড়লেই তাদের চেনা ঠিকানা ভারত। আসুন, আজ শুনে নিই সেই পরিযায়ীদেরই গল্প।
গুটিগুটি পায়ে আসছে শীত। সঙ্গে সঙ্গে আসছে শীতপোশাক, নবান্নের উৎসব। আর ক-দিন বাদেই হেঁশেল ম-ম করবে নতুন গুড়ের গন্ধে। এই সবের মাঝে দেশের দখল নেবে এক ঝাঁক অতিথি। কারও নেমন্তন্নের ধার ধারে না তারা।
শীত পড়তে না পড়তেই এই বাংলার দুয়ারেও কড়া নাড়ে তারা। সুজলা-সুফলা বাংলা ভরে ওঠে সেই অচিন পাখিদের ছোঁয়ায়। কারণ এই বাংলার মাটি হয়ে ওঠে তাঁদের আঁতুড়ঘর। এই আশ্রয় যে বেশিদিনের তা কিন্তু আদৌ নয়! ডিমের ভিতর থেকে ছোটো ছোটো ছানাদের ডানা মেলার অপেক্ষা কেবল। অমনি বাংলা মায়ের নাড়ির টান ঘুচিয়ে তারা চলে যায় নিজের বাড়ি। হ্যাঁ, তারা এমনই ঠাঁইনাড়া। তারা পরিযায়ী। শীতকাল ছাড়া আর কখনই তাদের দেখা মেলে না।
তারা আসে সাইবেরিয়া, ইউরোপ, রাশিয়া, চিনের মতো ভিনদেশ থেকে। চলে না এলে সেখানের তীব্র ঠান্ডায় যে তাদের ডিম জমে যাবে! শাবকরা চোখ মেলবে কেমন করে! আর তাই তারা খুঁজে নিয়েছে ভারতের কোলকেই। ভারত মূলত গ্রীষ্মপ্রধান দেশ। তাই এখানে ঠান্ডা ওদের কাছে বড় আরামদায়ক। বরফ-খসা তুষারের মরুভূমি এই সময় সেই পাখিদের কাছে মৃত্যুপুরী। খাবারের সংস্থান নেই, তার উপর যদি একসঙ্গে সবাই মিলে ডিম পারে, তাতে তো নিশ্চিতভাবেই সংকট দেখা দিতে পারে। তাই নয় কোনও রিস্ক। পত্রপাঠ সেই স্থান ত্যাগ করে নানা প্রজাতির বিদেশি পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে ভারতের নানা প্রান্তে। শীতকাল ছাড়া সারাবছর এসব পাখিদের দেখা মেলে না বলেই এরা ‘অতিথি পাখি’ বা ‘পরিযায়ী’ পাখি৷
আরও শুনুন: হিটস্ট্রোক হয় পাখিদেরও, উদ্ধারের পর বিনামূল্যে চিকিৎসা করে দেশের এই হাসপাতাল
তাদের উড়ে আসার এই পথ কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার। পৃথিবীর এক গোলার্ধ থেকে অন্য গোলার্ধ। শুধু কি তাই! এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার জন্য তারা বেশ কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করে। সেই পদ্ধতিগুলির অন্যতম একটি হল ওড়ার আগে শরীরে যথেষ্ট চর্বি এবং মাংস সঞ্চয় করা। উড়তে উড়তে তারা ঝরিয়ে দেয় শরীরের কিছু পালক। যাতে ওজন কখনই তাদের ওড়ার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়!
সাইবেরিয়ান সারস, এশিয়াটিক স্প্যারো, রেড উইং, হুইনচ্যাট, রোজফিঞ্চ, ব্ল্যাক হেডেড গুল, নরদ্যান ল্যাপউইং, গ্রে হেরন আরও কত নাম তাদের! কিন্তু প্রশ্ন হল তারা কেমন করে চেনে এই সুদীর্ঘ পথ? পক্ষীবিদরা অনুসন্ধান করে দেখেছেন, এই ধরনের পাখিদের মাথার একটি অংশ কম্পাসের মতো কাজ করে। আর এর সাহায্যেই নির্ভুলভাবে দিক নির্ণয় করে পরিযায়ীরা। এমনও মতামত আছে যে, পাখিদের চোখের মণির একটা বিশেষ অংশে থাকে চুম্বকক্ষেত্র। আর তা দিয়েই উত্তর-দক্ষিণ দিক তারা চিনে নেয় সহজেই। কোনও কোনও পাখি আবার নেয় অন্য পদ্ধতি। দিক চেনার জন্য তাদের অভ্রান্ত পদ্ধতি সূর্য এবং তারার অবস্থান। আকাশে উড়ে চলার সময় সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির উপস্থিতি বুঝেসুঝে নেয় তারা। আবার রাতে,নক্ষত্রের দিশা দেখে চিনে নেয় পথ। আর পথ চিনে ঘাঁটি গাড়ে এই দেশে।
এই বাংলার আড়ালে আবডালেও শীতের দিনে তাদের দেখা মেলে। বীরভূম, বর্ধমান, হাওড়া, চব্বিশ পরগণার নানা জায়গায় সপরিবারে বাস করে তারা। এই পাখিদের দেখতে ভিড় জমান উৎসাহী লোকজন। বিদেশভূমের অতিথি তারা। তাদের দেখা যেন বিদেশের-ই নাগাল পাওয়া! সেই উৎসাহকে পুঁজি করেই আজকাল বিভিন্ন ব্যবসায়িক কেন্দ্র গড়ে উঠছে বিভিন্ন জলের চরগুলিতে। তৈরি হচ্ছে বিলাসবহুল রিসর্ট, থাকা-খাওয়ার ব্যাবস্থা। নগরমুখী মানুষও লুফে নিচ্ছেন সেই সুযোগ। পাখি দেখাও হল, খানিক মনোরঞ্জনও হল। তাতে দোষ নেই। তবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন যাতে মানুষের উৎসাহ কোনওভাবেই তাদের সুরক্ষায় বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
এবছরও এর অন্যথা নেই। পরিযায়ী পাখিরা ভিড় জমিয়েছে বাংলার বুকে। খানিক জিরিয়ে নিয়ে ফিরে যাবে নিজেদের নীড়ে। পাখিদের ভাষা আমরা জানি না। তবুও জীবনানন্দ দাশে পঙক্তি মনে পড়ে, “ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর, স্কাইলাইট মাথার উপর, আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর!’
পাখিদের ভাষা জানা গেলে হয়তো বোঝা যেত, আথিথেয়তায় কোনও ত্রুটি রয়ে গেল কি-না!