দেখে মনে হবে ছাপা অক্ষর। অথচ সবটাই হাতে লেখা। লেখা বললে ভুল হবে, পুরোটাই ছবির মতো। সম্প্রতি নেটদুনিয়ায় ভাইরাল হয়েছে হাতে লেখা ভাগবত গীতার কিছু অংশ। লিখেছেন বাংলাদেশের মুহাম্মাদ। ধর্ম আলাদা, দেশ আলাদা, অথচ তারই সুপ্রাচীন ধর্মগ্রন্থকে হাতে লিখবেন, কেন এমন উদ্যোগ নিলেন তিনি? সংবাদ প্রতিদিন শোনো’র তরফে সেই খোঁজ নিলেন শুভদীপ রায়। ওপার বাংলা থেকে নিজের কথা জানালেন অক্ষরশিল্পী মুহাম্মাদ সাদ আহমেদ। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
সাদা পাতায় লেখা শ্রীমদ্ভাগবত গীতার প্রথম অধ্যায়। সেইসঙ্গে রয়েছে একটি হাতে আঁকা ছবিও। দেখে যেন বিশ্বাস হতে চায় না, সবটাই আসলে হাতে লেখা। ভরসা সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টের ক্যাপশন। যিনি লিখেছেন, পোস্ট করেছেন তিনিই। তিনিই উল্লেখ করে দিয়েছেন, গীতার কোন অংশ তিনি লিখেছেন, সেখানে কোন বর্ণমালার রীতি অনুসরণ করেছেন। আর সবটা দেখেই প্রশংসার বন্যা বয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, কোন কলম ব্যবহার করে এমন সুন্দর হস্তশিল্প করেছেন শিল্পী। যত্ন নিয়ে সেসবের উত্তর দিয়েছেন মুহাম্মাদ সাদ। আসলে, স্রেফ লিখতে হয় বলে তিনি লেখেন না। অক্ষরশিল্প তাঁর ভালোবাসার জায়গা। সেই ভালোবাসার টানেই এমনটা করেছেন। অবশ্য স্রেফ এই একটা কাজ নয়। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে শুরু করে দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা, আরও কত কী লিখেছেন মুহাম্মাদ। তবে গীতা যেহেতু হিন্দুদের সুপ্রাচীন ধর্মগ্রন্থ, তাই তা নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করছেন অনেকেই। তবে সেসব প্রশ্নের উত্তর খুব সহজভাবেই দিচ্ছেন মুহাম্মাদ।
তাঁর কথায়, গীতা হাতে লেখার ভাবনা হঠাৎ করে এসেছে বলা ঠিক হবে না। মূলত লেখালেখি নিয়েই তিনি সবসময় থাকেন। ঋগ্বেদ, সামবেদ, অথর্ব বেদের কিছু অংশ লিখেছেন। রামায়ণ, মহাভারত-সহ বিভিন্ন পুস্তকের অনুলিপিও করেছেন বিভিন্ন সময়ে। এ ছাড়া কুরআন, বাইবেল, গুরু গ্রন্থসাহিব, ত্রিপিটকেরও বিভিন্ন অংশ লিখেছেন। তাঁর যুক্তি, আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেহেতু এসব গ্রন্থ হাতে লিখেছিলেন, তাঁদের প্রতি সম্মান রেখেই তিনি হাতে লেখেন।
হাতের লেখা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে সাদ ফিরে যান ছোটবেলার প্রসঙ্গে। জানান, তাঁর প্রপিতামহ শখের ক্যালিগ্রাফার ছিলেন। সেই সময় তাঁদের বাস ছিল অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলায়। তখন ব্রিটিশ আমল। বাংলার স্থানে স্থানে গড়ে উঠেছে নীলকুঠি। বিভিন্ন চিঠি বা দলিল লেখার জন্য মুহাম্মাদের প্রপিতামহের শরণাপন্ন হতেন সাহেবরা। প্রপিতামহের সেই গুণই উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর কাছে এসেছে বলে মনে করেন সাদ। তবে সেই বংশানুক্রমিক সম্পদকেই অনুশীলন আর অধ্যবসায়ে মেজেঘষে নিয়েছেন তিনি। সে অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই করতে হয়েছে বলে জানাচ্ছেন সাদ। খাতায় একটা বর্ণ এলোমেলো হলে তাঁর বাবা খাতার ওই পৃষ্ঠাই ছিঁড়ে ফেলতেন। নির্দেশ ছিল, বইয়ের অক্ষরগুলো যেহেতু সোজা, লিখতেও হবে সোজা। দীর্ঘদিন এই অভ্যাসে থেকেই তাঁর হাতের লেখা হয়ে উঠেছে এমন ছবির মতো।
তবে ছোটবেলায় হাতেখড়ি তো হয় মাতৃভাষায়। হাতের লেখার অভ্যাসও চলে মায়ের ভাষাতেই। সাদ কিন্তু সেখানেও ব্যতিক্রম। ছোট থেকেই অন্য ভাষা শেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ প্রবল। বাড়িতে মায়ের কাছেই বাংলা এবং ইংরেজি শিখেছেন। তবে বাড়িতে পড়ে থাকা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্সের প্যাকেটের গায়ে লেখা চিনা ভাষার প্রতি তাঁর আলাদা আগ্রহ ছিল। ওগুলো দেখে দেখে লিখতেন। এ ছাড়া ওপার বাংলায় ভারত থেকে সরাসরি ফলের চালান হয়। এ দেশের বিভিন্ন খবরের কাগজে মুড়ে সেইসব ফল রাখা থাকত ওপার বাংলার দোকানে। দোকানদারদের বলে ওইসব পত্রিকা নিয়ে আসতেন সাদ। হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মলয়ালম সহ বিভিন্ন পত্রিকা। ছাপ দিয়ে বা দেখে দেখে সেখান থেকে অক্ষর লিখতেন। এভাবেই বিদেশি ভাষা শেখা শুরু মুহাম্মাদের। পরবর্তীকালে এই নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। আর আন্তর্জালের দৌলতে শেখার সুযোগও বেড়ে গিয়েছে এখন।
এই প্রসঙ্গ ধরেই তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, মোট কতগুলো ভাষা জানেন মুহাম্মাদ? উত্তর শুনে অবাক হতেই হয়। সাদ জানাচ্ছেন, কলেজে থাকতে বিশ্বের সব ভাষার সব লিপিতে নিজের নাম লিপিবদ্ধ করার ইচ্ছা হয়েছিল তাঁর। ততদিনে সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে বিভিন্ন ভাষা ও লিপি নিয়ে আগ্রহী অনেকের সাথে তাঁর আলাপ হয়েছে। এঁদের সহযোগিতায় প্রায় দু-বছর সময় নিয়ে, ৭৬৪২ রকমের ভাষায় নিজের নাম লিখেছিলেন সাদ। ইংরেজি, ফরাসি সহ যেসব ভাষা রোমান লিপিতে লেখা হয়, তার প্রায় সবই লিখতে পারেন সাদ। তাঁর কথায়, দীর্ঘ এ যাত্রায় অগণিত ভাষায় দেখে বা না দেখে লিখে ফেলেছেন তিনি।
তবে হাতের লেখা সুন্দর মানেই তো ক্যালিগ্রাফি নয়। অক্ষরশিল্পের কিছু নির্দিষ্ট ব্যাকরণ থাকে। সেসব শিখতে হয়। মুহাম্মাদ ক্যালিগ্রাফি শিখেছেন কীভাবে, সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানাচ্ছেন, অক্ষরশিল্প, ক্যালিগ্রাফি বা চারুলিপি-র ব্যাপক চাহিদা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে দেখা যায়। বাংলাদেশে যাঁরা করেন, তাঁরাও মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপীয় ক্যালিগ্রাফিকেই অনুসরণ করেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাধারণ গ্রাফিক্স ডিজাইন বিভাগে শেখানো হয় আর অনেকে ব্যক্তিগতভাবে শেখান। তবে এর বিস্তার এতই কম যে অনেকেরই অজানা, এমনকি একজন ক্যালিগ্রাফার আরেকজন ক্যালিগ্রাফারকেও চেনেন না। সাদও নিজের চেষ্টাতেই বিভিন্ন মানুষের কাছে শিখেছেন টুকিটাকি। তার সঙ্গে নিজের শিল্পকৌশল জুড়েছেন বারবার। কেউ যদি হাতের লেখা সুন্দর করার উপায় খুঁজতে চান, তাহলে কয়েকটা নিয়ম মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন সাদ। তাঁর কথায়, নিয়মিত লেখার চর্চাই আসল চাবিকাঠি। হাতের লেখা সুন্দর করতে হলে কলম কীভাবে ধরা হচ্ছে সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। নিবের কাছাকাছি ধরা চলবে না। একটু উপরে ধরে লিখতে হবে। প্রথমে অসুবিধা হলেও ধীরে ধীরে এমনটা অভ্যেস করে নিতে হবে। এ ছাড়া হাতের লেখা সুন্দর করতে বইয়ের অক্ষরগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখার কথা বলছেন সাদ। প্রয়োজনে একটি একটি বর্ণ লিখে অভ্যাস করতে হবে।
প্রশ্ন ছিল লেখার বিষয়েও। এতগুলো পাতা হাতে লেখা মোটেও সহজ কাজ নয়। দীর্ঘক্ষণ অনুলিখনে হাতে ব্যথা হয়? উত্তরে সাদ বলছেন, অবশ্যই হয়। তবে দীর্ঘদিনের অভ্যাস কিছুটা হলেও সহজ করে বিষয়টাকে। এ ছাড়া কলম ধরার উপরেও হাত ব্যথা নির্ভর করে। সাদ জানাচ্ছেন, যারা কলম শক্ত করে ধরে, তাদের দ্রুত হাত ব্যথা হবে। তাই কলম ধরতে হবে খুব হালকা করে এবং এমনভাবে লিখতে হবে যেন পরের পৃষ্ঠায় ছাপ না পড়ে। গীতার এ অংশের আঁকা ও লেখা নিয়ে মোট দু-ঘণ্টার মতো লেগেছে বলে জানিয়েছেন সাদ।
শ্রীমদ্ভাগবত গীতা ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন গ্রন্থ। ধর্মের সঙ্গেও তার অঙ্গাঙ্গী যোগ। তাই গীতার অনুলিখন করা নিয়ে মানুষের কৌতূহল অনেকটাই বেশি। সংস্কৃত ভাষাও যথেষ্ট কঠিন। সে ভাষা না শিখে কি গীতার শ্লোক নকল করা সম্ভব? সাদ কি তবে সংস্কৃত শিখে এই কাজে হাত দিয়েছিলেন? উত্তরে সাদ বলছেন, সংস্কৃত জেনে পড়ে এই কাজ শুরু করেননি। তবে কাজ করতে করতে সংস্কৃত জেনেছেন। লিপি নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে আবিষ্কার করেছেন, ভাষা এক হলেও, অঞ্চলভেদে সংস্কৃত লেখার ছাঁদ, শৈলী বদলে বদলে গিয়েছে। এই কাজের সূত্রেই সেইসব প্রাচীন লিপির পথেও সফর হয়ে গিয়েছে তাঁর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের ছাত্র মুহাম্মাদ সাদ-এর এই প্রতিভা আশ্চর্য করেছে নেটিজেনদের। তবে এমনটা যে একদিনে হয়নি তা তাঁর উত্তরেই স্পষ্ট। কাজের প্রতি ভালোবাসা আর অধ্যবসায়ের ফল এই শিল্প। আজ যা সকলকে মুগ্ধ করছে, তা আসলে দীর্ঘদিনের দীর্ঘ পরিশ্রমের নির্মাণ। লিপি ও ভাষা গবেষণার সুবাদে ভারতের রবীন্দ্র ভারতী, যাদবপুর, কলকাতা ও অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ভাষা গবেষকের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। আগামীতেও একইভাবে ভাষা ও লিপির এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে চান সাদ।
এও যেন এক সমন্বয়। ধর্ম তো আসলে ধারণ করে। সেখানে বিভাজনের বেড়া তুলে দেয় মানুষই। অক্ষরে ভালোবাসার কথা লেখা হয়, লেখা হয় ঘৃণাও। সেই অক্ষরের মধ্যে দিয়েই যেন মিলনের বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশের মুহাম্মাদ সাদ আহমেদ।