তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে নতুন করে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের দ্বার খুললেন মোদি। আর আবহে নতুন করে চর্চায় ফিরেছে নালন্দার ইতিহাস। জানা যায়, জ্ঞানের এই মহৎ প্রতিষ্ঠান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল মুসলিম হানাতেই। কিন্তু কেন? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
একসময় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভূ-ভারতে ছিল না। কেবল ভারত নয়, ভিন দেশের মেধাবী ছাত্রদেরও শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। তাও অল্প সময়ের জন্য নয়। প্রায় ৮০০ বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয় সুনাম ছড়িয়েছিল। যা এখনও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা। কিন্তু এর ব্যপ্তির ইতিহাস যেমন সুন্দর ধ্বংসের ইতিহাস ততটাই বিভৎস।
আরও শুনুনু: খুশির উৎসব নয়, বুলেট আর রক্তের গন্ধ চেনে যোগীরাজ্যের এই ইদের স্মৃতি
স্থাপত্য, শিল্প, শিক্ষা- একসময় গোটা বিশ্বে সবকটি বিষয়েই সেরার তালিকায় নাম ছিল ভারতের। তাজমহল থেকে শুরু করে দক্ষিণের বহু মন্দিরের কারুকাজ এখনও অবাক করে। শিক্ষাক্ষেত্রেও ছিল না ব্যতিক্রম। নালন্দা, তক্ষশীলা, বিক্রমশীলার মতো বিশ্ববিদ্যালয় জগত বিখ্যাত ছিল। তবে সে গৌরব হারিয়েছে বহুদিন। তার প্রধান কারণ বিদেশি শত্রুর আক্রমণ। বারে বারে শক, হুন, পাঠান কিং তুর্কি আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ভারত। ধংস হয়েছে বহু মন্দির। প্রাচীন মূর্তিও অচিরেই হারিয়ে গিয়েছে কালের গর্ভে। একইসঙ্গে দেদার চুরি এবং লুটপাট চলেছে। এ দেশের বহু মূল্যবান সামগ্রীই বিদেশি মিউজিয়ামে শোভা পায়। ব্রিটিস আমলে এই ধারা অব্যাহত ছিল। কোহিনূর হীরেই যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তবে এইসব চুরি, লুটপাটের চাইতেও কয়েকগুন বীভৎস ছিল বিদেশি শত্রুর হাতে ধংস হওয়া ভারতীয় ঐতিহ্য। এক্ষেত্রে সবার আগে বলতে হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা।
আরও শুনুন: মোদি সরকারের আমলে ৬০০ পেরোল রেল দুর্ঘটনা, কংগ্রেস যুগে সংখ্যাটা কত ছিল?
ইতিহাস বলছে, ৪২৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা কুমারগুপ্তের আমলে শিক্ষাকেন্দ্র তৈরি হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের হাতে নির্মিত এই শিক্ষাকেন্দ্রে ধর্মচর্চাই ছিল প্রধান বিষয়। পাশাপাশি পড়ানো হত হিন্দু দর্শন, বেদ, ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, ব্যকরণ, ভাষাতত্ত্ব, বিজ্ঞানের আরও বেশ কয়েকটি বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় খরচ চালাত রাজ পরিবার। তাই বলে রাজ পরিবারের কোনও কর্তৃত্ব ছিল না বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায়। মেধা এবং একমাত্র মেধাই ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের চাবিকাঠি। রাজপরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। এখানে পড়াশোনা হত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। উলটে পড়ুয়াদের খাবার হিসাবে নানা সামগ্রী পাঠানো হত। নালন্দার সবথেকে বড় আকর্ষণ ছিল এর পাঠাগার। নাম ছিল ‘ধর্মগঞ্জ’। এখানে কয়েক লক্ষ বই ছিল বলেই ধারণা ইতিহাসবিদদের। কেউ কেউ বলেন, উপনিষদের কয়েকটি অংশের আসল পাণ্ডুলিপি পর্যন্ত ছিল এখানে। কিন্তু এই পাঠাগার সম্পূর্ণভাবে পুরিয়ে দেওয়া হয়। তার কারণ অবশ্য একটা নয়। মূল্যবান গ্রন্থ থেকে শুরু করে আরও নানান সামগ্রীর লোভে এখানে আক্রমণ চালাত দুস্কৃতিরা। সেসব একপ্রকার সামলে নিলেও, ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে শেষ রক্ষা হয়নি। তুর্কি যোদ্ধা বখতিয়ার খিলজির আক্রমণেই রাতারাতি খাঁ খাঁ শ্মশানে পরিণত হয় জ্ঞান ও মেধার এই অনন্ত ভাণ্ডার। এর কারণ হিসাবে একাধিক ব্যাখ্যা মেলে। কেউ কেউ বলেন, প্রাচীন আয়ুর্বেদ এবং বৌদ্ধ ধর্মের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বই ছিল নালন্দার পাঠাগারে। যা ব্যক্তিগত স্বার্থেই ধ্বংস করেন খিলজি। আবার এমনটাও শোনা যায়, নালন্দার পাঠাগারে কোরান খুঁজে না পেয়েই ভয়ানক রেগে গিয়ে এই কাজ করেছিলেন খিলজি। তবে আরও একটি অদ্ভুত ব্যখ্যা শোনা যায় এ প্রসঙ্গে। কোনও এক ভয়ানক অসুখে শয্যাশায়ী হতে হয়েছিল খিলজিকে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ুর্বেদ প্রধান রাহুল শ্রীভদ্র ছাড়া আর কারও পক্ষে তাঁকে সুস্থ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ভারতের কোনও চিকিৎসক তাঁর প্রভুদের থেকে বেশি যোগ্য, এমনটা বিশ্বাসই করতেন না খিলজি। তাই চিকিৎসা করাতে রাজি হয়েও শ্রীভদ্রকে অদ্ভুত এক শর্ত দিয়ে বসেন খিলজি। কোনও ওষুধ না খাইয়ে সুস্থ করতে হবে মুসলিম শাসককে, এমনই চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয় নালন্দার আয়ুর্বেদ প্রধানকে। এহেন শর্তেও দমে যাননি রাহুল। খিলজিকে কোরানের কয়েকটি পাতা পড়িয়েই সুস্থ করে তোলেন তিনি। আসলে ওই পাতার গায়ে খিলজিকে না বলেই ওষুধ লাগিয়ে রেখেছিলেন রাহুল। এতেই ম্যাজিকের মতো সুস্থ হন খিলজি। কিন্তু সেই উপকারের দাম দেওয়া দূরে থাক, ছলের অপরাধে নালন্দাই ধংস করে দেন খিলজি। একইসঙ্গে হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারা হয়। যাঁরা বেঁচে যান, তাঁরাও পালিয়ে যান সেখান থেকে। খিলজির রাগের আসল কারণ কোনটি তা এখনও সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে নালন্দা ধংস গোটা বিশ্বের এক অপূরনীয় ক্ষতি।