গৌতম মুনির অভিশাপে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী অহল্যা। রামায়ণের এই কাহিনি কে না জানে! যেন তেমনই অভিশপ্ত এই আশ্চর্য জলাশয়ের জল। যে কোনও কিছু সেই জলে পড়ে গেলেই তা পাথরে পরিণত হয় মুহূর্তে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক এই অভিশপ্ত জলাধারের কাহিনি।
এই জলের ছোঁয়ায় নাকি পাথর হয়ে যায় সবকিছু। হ্যাঁ, এমনই বদনাম ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার অঞ্চলে থাকা এই জলাশয়ের। লোকে বলে, এক ডাইনির অভিশাপেই নাকি ঘটে এমন কাণ্ড। মানুষ থেকে জড় বস্তু, যে কোনও কিছুই নাকি ওই জলে পড়ে গেলে ক্রমশ পাথরে পরিণত হয়। এই কিংবদন্তির জেরেই কোনও মানুষ এই জলে ভুল করেও পা রাখেন না। তবে বাটি ঘটি থেকে আস্ত সাইকেল পর্যন্ত এই জলেই পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এমনটা দেখা যায় সত্যিই।
আরও শুনুন: ১১৫ ফুট মন্দির তৈরি হল রাতারাতি, ‘ভূতের মন্দির’ এখনও শিহরিত করে পর্যটকদের
জনশ্রুতি অনুযায়ী, পঞ্চদশ শতক নাগাদ এই এলাকায় বাস ছিল মাদার শিপটনের। স্থানীয় এক পতিতার কন্যা সে। বলাই বাহুল্য, মা-মেয়ে কাউকেই লোকালয়ে ঠাঁই দেয়নি সভ্য সমাজ। ওই জলাশয়ের কাছে জঙ্গলের মধ্যেই আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিল তারা। শিপটনের শিশুকালেই তার মায়েরও মৃত্যু হয়। জন্মগত ভাবেই শিপটনের কিছু শারীরিক ত্রুটি ছিল। লম্বা বাঁকা নাক আর বাঁকা পা, তার উপরে অনাদরে অযত্নে জটপাকানো চুল, নোংরা জামাকাপড়, সব মিলিয়ে তাকে এড়িয়ে চলত ওই এলাকার বাসিন্দা। আর এইভাবেই কখন যেন তার নামের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল ডাইনি তকমা। এদিকে ছোট থেকেই প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠার ফলে বিভিন্ন গাছপালা, প্রাকৃতিক উপাদানের গুণাগুণ সম্পর্কে শিপটনের জ্ঞান ছিল। সে সময়ে মানুষ রোগ সারানোর জন্য জড়িবুটি, তুকতাকের উপরেই ভরসা রাখত। তাই ভয়ভীতি থাকলেও ওষুধবিষুধের খোঁজে শিপটনের কাছে আসত মানুষ। সেই ওষুধ তৈরির সময় শিপটন এই জলাশয়ের জল ব্যবহার করত বলেও শোনা যায়। পাশাপাশি শিপটনের ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা ছিল বলেও মানুষ বিশ্বাস করত। আর এই সব কিছুই সমাজের বাইরে থাকা এই একলা মেয়েটিকে আরও বেশি অলৌকিক করে তুলেছিল। যা কিছু সমাজের চলতি ছকের বাইরে, বা যা সাধারণ মানুষের বোধে ধরা দিচ্ছে না, তাকে অশুভ বলে দাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতা তো সেকালে ছিলই। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এহেন ঘটনা ঘটলে তাকে ডাইনি বলে একঘরে করে দেওয়া যেত আরও সহজে। যার জেরে জোয়ান অব আর্ককে পুড়িয়ে মারার মতো ঘটনাও ঘটেছিল। কথিত আছে, মাদার শিপটনকেও এলাকাবাসীরা রীতিমতো হেনস্তা করেছিল। আর তার মৃত্যুর পরেই তাই তার অভিশাপ লাগে এই জলাশয়ে, এমনটাই বিশ্বাস অনেকের।
আরও শুনুন: ৪০০ বছর ধরে সমুদ্রে ঘুরে চলেছে ভূতুড়ে জাহাজ! কী এই রহস্য?
শোনা যায়, গাছের শুকনো পাতা, কাঠের টুকরো, ফুল ইত্যাদি জলাশয়ে পড়ে পাথর হয়ে আছে, এমনটা দেখা গিয়েছিল প্রথমে। কৌতূহলের বশে কেউ কেউ কোনও জিনিস জলে ফেলে দেয়। আর তারপরেই চমক। এমনকি পরবর্তী কালে পরীক্ষা করার জন্য অনেক জিনিস দড়ি বেঁধে জলে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দেখা গিয়েছে, দড়ির কিছু অংশ সহ ঝুলন্ত বস্তুগুলি সম্পূর্ণ পাথরে পরিণত হয়েছে। আশঙ্কায় ওই জলে নামার সাহস করেননি কেউই। তবে জল ও আশেপাশের মাটির নমুনা পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীদের ধারণা, কুয়োর জলে এমন কিছু খনিজ রয়েছে যার রাসায়নিক প্রভাবে সবকিছু পাথরে পরিণত হয়ে যায়। এই রহস্যের সমাধান হলে হয়তো ডাইনি তকমা মুছে শান্তি পাবেন সেই একলা মেয়েটিও। যাঁর নিজের জীবনটাও এই অভিশপ্ত জলাশয়ের চেয়ে কম দুর্ভাগ্যের ছিল না।