চালের সঙ্গে জড়িয়ে ভগবানের নাম। এমনটা শুনলেই মনে আসে গোবিন্দভোগ চালের কথা। তবে আরও চাল রয়েছে যার সঙ্গে সরাসরি ভগবানের যোগ। বুদ্ধ চাল এরই অন্যতম। জানা যাচ্ছে, স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় এই চালের রপ্তানি আরও বাড়াচ্ছে কেন্দ্র। কীভাবে এর সঙ্গে ভগবান বুদ্ধের নাম জুড়ল? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
ভারত কৃষিপ্রধান দেশ। দু’মুঠো চালের কদর করতে জানে এ দেশের মানুষ। তাই শুভ কাজে হোক বা রোজনামচা, চালের প্রয়োজন সবসময়। দেশজুড়ে ফলনও কম হয় না। এমনকি দেশের বাইরে রপ্তানির সুযোগও মেলে। সেই তালিকায় বেশ স্পষ্ট একটাই নাম, বুদ্ধ চাল (Buddha Rice)।
শুধু নামে নয়, এর সঙ্গে সত্যিই ভগবানের বুদ্ধের যোগ রয়েছে। তাও কোনও একটা বিষয়ে নয়, বিভিন্ন দিক দিয়ে এই চালের সঙ্গে ভগবান বুদ্ধের যোগ খুঁজে পাওয়া যায়। সে প্রসঙ্গে আসছি, তার আগে বলি এই চালের এত কদর কেন? প্রথমত এর স্বাদ এবং গন্ধ। অতুলনীয় বলাই যায়। কেউ কেউ দাবি করেন এই চালের ভাত যতই খাও পেট বা মন ভরতে চায় না। বিশেষ ওষধি গুণ রয়েছে এই বুদ্ধ চালের (Buddha Rice)। তবে একটা বিষয়ে এই চাল অন্য চালের থেকে আলাদা। তা হল এর রং। প্রথমবার দেখলে মনে হবে একেবারে কালো। তবে আসল রঙটা একটু গাঢ় বাদামী। তাই একে ‘কালা নমক’ নামেও ডাকা হয়। তবে স্থানীয়দের কাছে কিংবা প্যাকেটের গায়েও সেই বুদ্ধ নামই বিরাজমান। শোনা যায়, এই চাল রাজাদের অতি প্রিয় ছিল। বেনারসের বিভিন্ন রাজপরিবারে এই চাল খাওয়ার চল ছিল। কারণটা সহজেই অনুমেয়। সেই স্বাদ আর গন্ধ। একসময় এই চাল দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বুদ্ধ চাল (Buddha Rice) হারিয়ে যেতে থাকে। এবং একেবারে অবলুপ্ত হয়ে যায়। নেপথ্যের কারণ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে নতুন করে কয়েকজন গবেষক এই ‘বুদ্ধ চাল’ (Buddha Rice) ফিরিয়ে এনেছেন। তাতে কিছু কৃষক পরিবারের অক্লান্ত পরিশ্রমও রয়েছে। তবে সেই গল্পে যাওয়ার আগে এই চালের সঙ্গে বুদ্ধের যোগ কোথায় সেটা বলি।
এদেশে প্রথম থেকেই চালের ফলন রয়েছে। তবে বুদ্ধ চাল (Buddha Rice) এদেশে এসেছে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধের হাত ধরে। পর্যটক ফা হিয়েনের লেখায় সেই প্রমাণ মেলে। গল্পটা খানিকটা এরকম, সংসার ছেড়ে যাওয়ার পর সিদ্ধার্থ আবার কপিলাবস্তু ফিরে এসেছিলেন। ততদিনে তাঁর ঐশ্বরিক ক্ষমতা বা সেই সংক্রান্ত খবর লোকমুখে ভালোই ছড়িয়েছে। অনেকেই আসছেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করছেন, শান্ত মনে ফিরে যাচ্ছেন। তবে স্থানীয় মাথলা গ্রামের মানুষজন বুদ্ধকে দেখে বেশ আবগেপ্রবণ হয়ে পড়লেন। সকলে ঘিরে ধরলেন বুদ্ধকে। আবদার, ছেড়ে যাওয়া যাবে না। তাও যদি যেতেই হয়, তাহলে কিছু প্রসাদ অন্তত দিয়ে যেতে হবে। এই কথা শুনে ভগবান বুদ্ধ একমুঠো শস্য গ্রামের একজনের হাতে দিয়ে বলেন, ‘এই শস্য ফললে আমার কথা মনে পড়বে তোমাদের’। ফা হিয়েনের কথায়, ওই শস্য আসলে ছিল কালানমক চালের বীজ। যা স্বাদে গন্ধে এমনই অনন্য ছিল যে ঈশ্বরের প্রসাদ ভাবাই যায়। তার ওপর স্বয়ং বুদ্ধ হাতে করে দিয়েছেন। কাজেই এই চালের সঙ্গে জুড়ল ভগবানের বুদ্ধের নাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ছড়িয়ে পড়ল। তবে অনেকেই বলেন গৌতম বুদ্ধের বাবার আমলে এই চাল ভারতে আসে। সেক্ষেত্রে অবশ্য উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই সিদ্ধার্থ তথা বুদ্ধ এই চালের সঙ্গে ছোট থেকেই পরিচিত, এমনটা ধারণা করা হয়। শুধু তাই নয়, এর চাষও হত ওই বিহারের আশেপাশে। সেখান থেকে বুদ্ধের জন্মস্থান খুব দূর নয়। সুতরাং এই সূত্রেও বুদ্ধের সঙ্গে চালের যোগ রয়েছে।
যদিও এই ‘বুদ্ধ চালের’ (Buddha Rice) হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টা এখনও তেমন পরিষ্কার নয়। ফিরে আসার গল্পটা তাই বেশ চর্চিত। স্বাস্থ্যগুণের পাশাপাশি এই চালের সঙ্গে ঐতিহাসিক যোগও বেশ স্পষ্ট। তাই বুদ্ধ চাল ফিরিয়ে আনার জন্য বিশেষ উদ্যোগী হয় উত্তরপ্রদেশ সরকার। প্রায় ২০ বছরের চেষ্টার পর ফের দেশের মাটিতে ফলতে শুরু করে এই কালোচাল। ২০১৩ সালে বুদ্ধ চালকে ‘জিআই ট্যাগ’ দেওয়া হয়। তাতে বলা হয় সিদ্ধার্থ নগর বা তার আশেপাশের অঞ্চলেই এই চালের ধান চাষ করা যাবে। খোদ প্রধানমন্ত্রী এই চালের প্রশংসা করেছেন, বিশেষ স্বীকৃতিও দিয়েছেন। বর্তমানে এই চাল বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয় কেন্দ্রের তরফে। সিঙ্গাপুর, লন্ডন সহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ রয়েছে তালিকায়। তাতে কেন্দ্র সরকারের লাভ মন্দ হয় না। অতএব ভগবানের নামের সঙ্গে মিশে থাকা এই চাল স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় তো বটেই, দেশের নাম বিদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রেও সমান কার্যকর।