শাস্ত্রমতে দেবী দুর্গার বাহন পশুরাজ সিংহ। তবু প্রতিবছর শোনা যায় মায়ের আগমন হয়েছে অন্য কোনও ‘বাহনে’ চড়ে। কখনও গজ, কখনও ঘোড়া আবার কখনও নৌকা কিংবা পালকি। এই চার যানে চড়েই মর্তে আসেন মা। কিন্তু প্রতিবছর নিয়ম করে অদলবদল ঘটে এই যানগুলির। কীভাবে নির্ধারিত হয় সেই ধারা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
দেবীর মর্তে আগমন বাঙালির কাছে ঘরের মেয়ের বাপের বাড়ি ফেরার মতোই। বাড়ির মেয়েকে ঘরে আনার জন্য যেমন গাড়ি পাঠানো হয় তার বাপের বাড়ি থেকে, দেবী দুর্গাকে মর্তে আনার জন্যেও তাই থাকে এমন ব্যবস্থা। দেবীপক্ষের মাঝে বাহনসুদ্ধ উমাকে সপরিবারে মর্তে নিয়ে আসার দায়ভার পড়ে বিশেষ চার যানের উপর। দুর্গাষষ্ঠীতে দেবীর বোধন সম্পূর্ণ হলেও, মায়ের মর্তে আগমনের আসল তিথি সপ্তমী। এই দিন থেকে দেবী আরাধনার আসল উপাচার শুরু করা হয়। তাই দুর্গা সপ্তমীর অবস্থান দেখেই স্থির করা হয় দেবীর আগমন কোন যানের মাধ্যমে হবে।
আরও শুনুন: দশভুজা দুর্গা নন, কেবল দেবীর মুণ্ডকেই অর্ঘ্য দেওয়া হয় এই বনেদি পুজোয়
শাস্ত্রে বলা হয়, “রবি চন্দ্রে গজারূঢ়া, ঘোটকে শনি ভৌময়োঃ,
গুরৌ শুক্রে চ দোলায়াং, নৌকায়াং বুধবাসরে।”
অর্থাৎ, সপ্তমী রবি বা সোমবার হলে দেবীর বাহন হবে গজ বা হাতি। সপ্তমী শনি বা মঙ্গলবার হলে দেবীর বাহন হয় ঘোটক বা ঘোড়া। সপ্তমী বৃহস্পতি বা শুক্রবার হলে দেবীর বাহন দোলা বা পালকি। আবার সপ্তমী বুধবার হলে দেবীর বাহন হয় নৌকা।
একইভাবে দশমী তিথির সাপ্তাহিক অবস্থান দেখে স্থির করা হয় মায়ের গমন হবে কোন যানের মাধ্যমে। যেমন দশমী যদি রবি বা সোমবার হয়, তাহলে দেবীর বাহন হয় গজ। দশমী শনি বা মঙ্গলবার হলে দেবী বিদায় নেবেন ঘোড়ায় চড়ে। দশমী বৃহস্পতি বা শুক্রবার হলে দেবীর গমন হবে দোলা বা পালকিতে। আবার দশমী বুধবার হলে নৌকায় করে কৈলাসে ফিরবেন দেবী। সাধারণত প্রতি বছর দুর্গার আগমন ও প্রস্থান সাধারণত একই বাহনে হয় না। যদি কোনও বছর হয়‚ তবে তা খুবই অশুভ ইঙ্গিত বহন করে বলেই মনে করেন ভক্তরা।
আরও শুনুন: এক রাতের মধ্যেই পুজোর আয়োজন, আজও বিসর্জন হয় না সোনার দুর্গার
তবে এই আগমন গমনকে ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে আরও কিছু কিংবদন্তি। পঞ্জিকামতে গজ দেবীর শ্রেষ্ঠ যান। তাই দেবীর আগমন বা গমন হাতিতে হলে মর্তলোক ভরে ওঠে সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধিতে। পূর্ণ হয় ভক্তদের মনোবাঞ্ছা। পরিশ্রমের সুফল পায় মর্তলোকের অধিবাসীরা। অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি নয়, ঠিক যতটা প্রয়োজন ততটা বর্ষণ। অন্যদিকে দুর্গা যদি ঘোড়ায় চড়ে আসেন বা বিদায় নেন, তবে তার ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সামরিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। রাজায়-রাজায় বা রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে যুদ্ধ সূচিত হয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরে ধ্বংস ও অস্থিরতা বিরাজ করে। আবার দেবীর দোলায় আগমন ও পালকিতে গমন হলে তার ফল হয় ভয়ংকর। দেশজুড়ে দেখা দেয় মহামারী, ভূমিকম্প, খরা, যুদ্ধের মতো ভয়ংকর লক্ষণ, যাতে বিপুল প্রাণহানি অনিবার্য। আবার দেবীর আসা বা যাওয়া নৌকায় হলে প্রবল বন্যা ও খরা দুয়েরই প্রকোপ দেখা দিতে পারে, এমনটাই বিশ্বাস ভক্তদের। কিন্তু নৌকায় গমন মনস্কামনা পূর্ণ হওয়া সূচিত করে। ফলে ধরিত্রী হয়ে ওঠে শস্যশ্যামলা। আসলে কৃষিকাজই যে একসময় এই বাংলার প্রধান জীবিকা ছিল, সেই ইঙ্গিত দিয়ে যায় এই কিংবদন্তিগুলি।
(ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী)