আচ্ছা ‘দুর্গা’ নামটা শুনলেই, চোখের সামনে ঠিক কী ভেসে ওঠে? দশভুজা দেবী, মহিষাসুরমর্দিনী, মাতৃস্বরূপা চণ্ডীকা। এ ধারণায় কোনও ভুল নেই। তবে দুর্গা মানে শুধুই যে ওই একটি মাত্র রূপ তা নয়। শাস্ত্রীয় বাখ্যায় তিনি যেমন ধরা দিয়েছেন ভিন্নমাত্রায়। লৌকবিশ্বাসেও ধরা পড়েছে দুর্গার নানা রূপ। দেবীর সেইসব রূপের কথাই শুনে নেওয়া যাক। আজ রইল ‘ওলাইচন্ডী’-র বর্ণনা।
দেবী দুর্গাকে যে রূপে আমরা অর্চনা করি, তিনি মাতৃস্বরূপা। আবার অন্যদিকে তিনিই চণ্ডী। অসুরদলনী, দশপ্রহরণধারিণী। স্বাভাবিক ভাবেই লৌকিক বিশ্বাসে দেবীর যে বিভিন্ন রূপ দেখা যায়, সেখানেও দেখা মেলে দেবীর এই ‘চন্ডী’-রূপটি। এক নয়, একাধিক লৌকিক দেবীর সঙ্গেই জুড়েছে এই ‘চণ্ডী’ শব্দটি। তবে তার মধ্যে সবথেকে প্রচলিত দেবী ‘ওলাইচণ্ডী’।
লৌকিক দেবতা মানেই সেখানে ধর্মের বাঁধন অনেকটা আলগা। অর্থাৎ কোনও নির্দিষ্ট একটা ধর্মের মানুষই সেই দেবতার আরাধনা করবেন এমনটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় না। ওলাইচণ্ডীও এর ব্যতিক্রম নন। পার্থক্যটা স্রেফ নামের। হিন্দু ক্ষেত্রে তিনি ওলাইচণ্ডী আর মুসলিমদের কাছে তিনিই ওলাবিবি। কিন্তু কেন এই নাম?
এককালে ‘কলেরা’-র কোনও ওষুধ ছিল না। বিশেষত গ্রামের এই রোগ সহজেই মহামারীর আকার ধারণ করত। স্থানীদের মধ্যে এই রোগের নাম ছিল, ‘ওলাওঠা’ বা ‘ওলাউঠা’। ‘ওলা’ মানে নামা বা দাস্ত হওয়া আর ‘উঠা’ মানে উঠে যাওয়া বা বমি হওয়া। অর্থাৎ যে রোগে দাস্ত ও বমি দুইই হয় তাঁকে ‘ওলাউঠা’ বলে। সেই ওলাওঠা রোগ সারিয়ে দেন যে দেবী, তিনিই ওলাইচণ্ডী। স্থানীয় বিশ্বাস, এই দেবীর পুজো করলেই ওলাউঠা রোগ সেরে যায়। তাই বিশেষ আচার মেনে ওলাইচণ্ডী বা ওলাবিবি পুজোর চল রয়েছে বিভিন্ন গ্রামে। এবার আসা যাক দেবীর মূর্তি প্রসঙ্গে। সাধারণত এই দেবীর দু-ধরনের মূর্তি দেখা যায়। হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে দেবীর রূপ লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মতো। গায়ের রং হলুদ, অত্যন্ত সুশ্রী, মূলত দ্বিনয়না। আবার কোথাও দেবীকে ত্রিনয়না রূপেও দেখা যায়। নানা অলংকারে দেবী মূর্তি সুসজ্জিতা। পরনে মূলত শাড়ি এবং মূর্তিটি সাধারণত দণ্ডায়মান। কোথাও দেবীর বাহন হিসেবে ঘোড়া দেখা যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেবী মূর্তিতে কোনও বাহন নেই। কিছু কিছু জায়গায় দেবীর স্রেফ মুন্ডটিকেই পুজো করা হয়। প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হয় ঘটে। তবে মুসলমান-প্রধান অঞ্চলে, অঞ্চলে অর্থাৎ ওলাবিবিরর মূর্তি কিছুটা আলাদা। তার পরনে পিরান বা ঘাগরা জাতীয় পোশাক। মাথায় টুপি ও পায়ে নাগরা জুতো। তবে সেক্ষেত্রেও দেবী মূর্তিতে নানা ধরনের গয়না থাকে।
শাস্ত্রে এই দেবীর তেমন উল্লেখ নেই। তাই এর পুজোর জন্য পঞ্জিকাতেও আলাদা কোনও দিন দেখা যায় না। সেক্ষেত্রে যে কোনও দেবীর পুজো শনি-মঙ্গলবারে করার যে প্রচলিত নিয়ম রয়েছে, ওলাবিবি পুজোর ক্ষেত্রেও সেটিই করা হয়। কিছু কিছু জায়গায় পুজো হয় প্রতি শুক্রবারে। বিশেষ কোনও মন্ত্র নেই। থাকলেই তা অঞ্চল ভেদে ভিন্ন। নেই কোনও পুরোহিতও। যেহেতু লৌকিক দেবী, তাই যে যার নিজের মতো করে দেবীর আরাধনা করেন। কোথাও কোথাও মেয়েদেরও এই দেবীর পুজোয় পৌরহিত্য করতে দেখা যায়। নিত্যপুজোয় আড়ম্বর হয় না বললেই চলে। সন্দেশ, পান-সুপারি, বাতাসা, আতপ চাল, পাটালি ইত্যাদি শুকনো নৈবেদ্যে দিয়ে পুজো সারা হয়। একে বলা হয় ‘মাঙন প্রথা’। এর সঙ্গে আরও এক লৌকিক আচার দেখা যায়, যাকে বলে ছলন বা সলন। কারও মনের ইচ্ছা পূর্ণ হলে, দেবীর থানে ছোট ছোট মূর্তি বসিয়ে যাওয়ার চল রয়েছে। এছাড়া দেবীর বাৎসরিক পুজো বা বিশেষ পুজোও হয়। সেখানে অন্নভোগ বা আরও অনেক কিছু দেওয়া হয়। কখনও ছাগ বলিও হয় ওলাইচণ্ডী মানসিক পুজোয়।
তবে লৌকিক দেবী মানেই যে তিনি স্রেফ গ্রামাঞ্চলে পূজিতা তা নয়। কলকাতাতেও রয়েছে দেবীর মন্দির। চৈত্র মাসে সেখানে বিরাট মেলা বসে। তবে গ্রামের দিকে এই দেবীর মন্দির চোখে পড়ে যথেষ্টই। বিশাল কিছু না হলেও, অন্তত একটা বেদী আর সেখানে প্রতিষ্ঠিত দেবী ওলাইচণ্ডী। আসলে এই দেবীকে গোটা বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বলা যেতে পারে। একইসঙ্গে দেবীর আরাধনায় সম্প্রীতির নজিরও চোখে পড়ে যথেষ্টই। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ১৯শ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে কলেরার দেবী রূপে এই ওলাইচণ্ডীর পূজা শুরু। ধীরে ধীরে দেবীর গুরুত্ব সাম্প্রদায়িক ও বর্ণব্যবস্থার সীমারেখাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। যদিও আধুনিক যুগে কলেরার চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। তাই ওলাইচণ্ডীর পূজো কিছুটা হলেও সীমিত হয়েছে। কিন্তু এতদিনের দেবীত্বে ইনি আর স্রেফ কলেরার দেবী নেই। তাই সাধারণ কোনও সমস্যা থেকে মুক্তি পেতেও দেবীর শরণাপন্ন হন ভক্তরা। আর সন্তান স্নেহে তাদের আগলে রাখেন দেবী।