ধনতেরস। সোনার দোকানে গয়না কেনার ধুম। সামর্থ্য না থাকলে, পিতল কাঁসা কিংবা স্টলের বাসন কেনা। কিছু একটা ধাতব জিনিস ওইদিন বাড়িতে আনাই প্রচলিত রীতি। সত্যিই কি এই রেওয়াজ স্রেফ সংস্কার? নাকি এর নেপথ্যেও রয়েছে শাস্ত্রের ব্যাখ্যা? আসুন শুনে নিই।
ধনতেরস কথাটি এসেছে ধন ত্রয়োদশী থেকে। অমাবস্যায় যে শ্যামাপুজো হয়, ঠিক তার দুদিন আগের তিথি এই ধন ত্রয়োদশী। একসময় মূলত উত্তর ভারতেই এর প্রচলন ছিল। তবে বর্তমানে সারা দেশ জুড়েই পালিত হয় ধনতেরস উৎসব।
আরও শুনুন: ‘লাভ জিহাদে’র ছল! হিন্দু মেয়েদের মেহেন্দি পরাতে পারবেন না মুসলিম শিল্পীরা, ফতোয়া যোগীরাজ্যে
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো ছাড়া, লক্ষ্মীদেবীর আরাধনার আর যে-সকল রীতি আছে, তার মধ্যে অন্যতম দীপান্বিতা লক্ষ্মীপূজা। যা পালিত হয় কার্তিক অমাবস্যার দিনেই। অর্থাৎ, কালীপুজোর সময়ও লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। সেই উৎসবেরই ছায়া দেখা যায় ধনতেরাস পালনের মধ্যে। মনে করা হয়, কালীপুজোর আগে এই ত্রয়োদশীর দিন দেবী লক্ষ্মী এসে ভক্তদের ধনসম্পত্তি দান করে মনোবাসনা পূর্ণ করেন। তাই এই সময়টায় সোনা-রূপো কেনাকাটার ধুম লেগে যায়। যাঁদের সামর্থ্য নেই, তাঁরা অন্য কোনও ধাতু কেনেন। ধনতেরসে লোহা বাদে যে কোনও ধাতুর জিনিস কেনাই শুভ মনে করা হয়। তবে শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এই তিথি ঠিক দেবী লক্ষ্মীর আরাধনার জন্য নয়। বরং ধনতেরস নামটি যার থেকে এসেছেন, সেই ধন্বন্তরীর পুজো করার তিথি হল এই ত্রয়োদশী। যদিও দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে এই তিথির একেবারে যোগ নেই বললে ভুল হবে। দেবীর কোষাধক্ষ্য অর্থাৎ কুবের মহারাজের পুজোও হয় এই ধনতেরসের দিনেই। এইদিন সোনা কেনার নেপথ্যে রয়েছে অন্য এক গল্প।
আরও শুনুন: কপালে তিলক, গায়ে গোমূত্র ছেটানোর নির্দেশ! অহিন্দু প্রবেশ রুখতে ‘গরবা’-য় জারি নয়া ফরমান
কাহিনিটি কুশীলব রাজা হিমার ছেলেকে কেন্দ্র করে। এর সঙ্গে বাংলার বাহুলার লখিন্দরের কাহিনিরও বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এখানেও রাজপুত্রের ছিল সর্পদংশনে মৃত্যুর অভিশাপ। কিন্তু সেই মৃত্যু আটকে দিয়েছিলেন তাঁর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। কথিত আছে, বিয়ের পরই রাজপুত্রের অভিশাপের কথা জানতে পারেন নববধু। সদ্য বিবাহিত স্বামীকে হারাতে হবে শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তবে একইসঙ্গে অদ্ভুত এক ফন্দিও এঁটে ফেলেন স্বামীর প্রাণ বাঁচানোর। তিনি ঠিক করেন, যেদিন রাতে মৃত্যর আসার কথা, সেদিন সারা ঘরে উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে রাখবেন। পরিকল্পনা মতো তা করলেনও। শুধু তাই নয়, সেই আলো আরও উজ্জ্বল করতে ঘরের যাবতীয় সোনা-দানা এনে জড়ো করেন সেই ঘরে। একইসঙ্গে ঠিক করলেন, সারারাত স্বামীর সঙ্গে বসে গল্প করবেন। যথাসময়ে মৃত্যু উপস্থিত। কিন্তু উজ্জ্বল আলোয় তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তিনি খুজেই পেলেন না ঘর থেকে বেরোনোর পথ কোনদিকে। বাধ্য হয়ে সোনার রাশির উপর বসে বসে নবদম্পতির গল্প শুনতে থাকলেন। এদিকে সময় যে পেরিয়ে গিয়েছে সে খেয়াল তাঁর নেই। সকাল হতেই মৃত্যুর আর কিছু করার ক্ষমতা নেই। বাধ্য হয়েই তিনি খালি হাতে ফিরলেন যমলোকে। সে যাত্রায় রাজপুত্রের প্রাণ বেঁচে গেল স্ত্রীর বুদ্ধিমত্তার জোরে। দিনটি ছিল কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীর দিন। তাই এইদিনেই শুরু হল ধনতেরাস উৎসব। আজকে যে রীতি মেনে সোনা কেনা হয়, তার নেপথ্যে রয়েছে এই গল্পেরই ছায়া। মনে কর হয়, ঘরে সোনাদানা থাকলে যে কোনও বিপদের মোকাবিলা করা সম্ভব। যা পারতপক্ষে ভুল নয় একেবারেই। তাই বছরের একটা বিশেষ দিনে সোনা কেনার চল রয়েছে। তবে স্রেফ কিনলেই হল না, একইসঙ্গে ধনতেরসে বিশেষ কিছু নিয়ম মানাও আবশ্যক। যার মধ্যে প্রথমেই বলতে হয়, শুদ্ধাচারের কথা। এইদিন আলাদাভাবে বাড়িতে কোনও পুজার ব্যবস্থা না করলেও, চেষ্টা করুন মাংস বা মদ্যপান না করার। কাউকে অসম্মান করবেন না ভুল করেও। সোনা কিনতে যাওয়ার পথে কেউ যদি সাহায্য চায় যথা সম্ভব চেষ্টা করুন সাহায্য করার। সম্ভব হলে অভুক্তকে কিছু খেতে দিন। যে কোনও ব্রতের দিনেই এমনটা করা বিশেষ শুভ। যদিও ধনতেরস ঠিক ব্রত নয়। প্রচলিত ধারণার আঙ্গিকে গড়ে ওঠা এক লৌকিক উৎসব বলা চলে।