সংবাদের শিরোনামে ডি গুকেশ। বয়স কাঁচা হলেও দাবার ছক তাঁর হাতের মুঠোয়। দাবায় যখন দেশে এসেছে বিশ্বসেরার খেতাব,তখন একবার ফিরে তাকানো যেতে পারে দাবার ইতিহাসে। দেখা যাবে, সে ইতিহাসে অনুষঙ্গে জড়িয়ে আছে রামায়ণ। আসুন, শুনে নেওয়া যাক দাবার গল্প।
সর্বকনিষ্ঠ প্রতিযোগী হিসাবে সম্প্রতি দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব জিতেছেন গুকেশ। চিনের ডিং লিরেনকে হারিয়ে কিস্তিমাত করেছেন তিনি। ইতিহাসের দিকে চোখ রাখলে দেখা যায়, দাবা খেলায় বারবার ভারতই ছিনিয়ে এনেছে জয়ের মুকুট। এই ধারাবাহিক বিজয়ের পিছনে যেন রয়েছে একটি রহস্য! রামায়ণের পাতায় চোখ রাখলেই পাওয়া যায় তার হদিশ। স্বয়ং মন্দোদরীই নাকি প্রচলন করেছিলেন এই ‘যুদ্ধখেলা’।
কেন এমন খেলা চালু করলেন তিনি?
দাবার বোর্ডের দিকে তাহলে একবার তাকিয়ে দেখা যাক। সাদা-কালোর ৬৪টি খানা ঘর। আর তাতে ছড়িয়ে আছে হাতি, ঘোড়া। রয়েছে সৈন্য-সামন্ত। যানবাহন হিসেবে রয়েছে নৌকা। সব মিলিয়ে ১৬ খানা। এই সবকিছুর মধ্যমণি হিসাবে রয়েছেন রাজা ও মন্ত্রী। মন্ত্রীর ক্ষমতা অপরিসীম। আর রাজার পদক্ষেপ ধীর, অচঞ্চল। দাবার বোর্ড যেন এক প্রসারিত যুদ্ধক্ষেত্র-ই। দুই দিকে দুই রাজশক্তি। নিখুঁত পরিকল্পনা মাফিক প্রতিটি চালে ধ্বংস হয়ে যাবে বিপক্ষের শত্রুশিবির। তবে মন্ত্রী-শান্ত্রীদের নিজেদের চলাফেরা করার ক্ষমতা নেই। কারণ তারা সকলেই এক-একটি সাদা-কালো ঘুঁটি মাত্র। আসলে তাদের পরিচালনা করেন দুই প্রতিপক্ষ অর্থাৎ দু’জন প্রতিযোগী। এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দাবার গুটি কাল্পনিক হলেও এই খেলার উত্তেজনা যেন যুদ্ধভূমিরই। যেসব মানুষের মধ্যে বয়ে চলেছে লড়াইয়ের নেশা, তাঁদের কাছে দাবার মতো আকর্ষণীয় খেলা খুব কম আছে। আর এই মনস্তত্ত্বকেই নাকি কাজে লাগিয়েছিলেন সে-যুগের রানি মন্দোদরী।
আরও শুনুন: বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে শতাধিক রামায়ণ, রামকে কেন্দ্র করেই জারি ভিন্নমতের অধিকারও
রাবণের চরিত্রের মধ্যেই যেন ছিল যুদ্ধের প্রবণতা, আগ্রাসন। প্রতিপক্ষকে নিজের হাতের মুঠোয় আনতে বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। তাই অধিকাংশ সময় মেতে থাকতেন তা নিয়েই। কিন্তু মন্দোদরীর ভিতরে ছিল এক অন্য অভিসন্ধি। স্বামীর এই হিংস্রতাকে তিনি মুছে দিতে চেয়েছিলেন চিরতরে। আর তাই সুকৌশলে তৈরি করেছিলেন এমন এক খেলা, যার নেশায় বুঁদ হয়ে থামানো যেতে পারে রক্তপাতের সম্ভাবনা।
তবে এই কালো এবং সাদা দুই রঙের বিভাজনের পিছনে কি কোনও বিশেষ ইঙ্গিত ছিল মন্দোদরীর? রামরাজ্যের আর্যপুরুষের গায়ের রঙের ঔজ্জ্বল্য এবং দাক্ষিণাত্যের রক্ষবংশের বর্ণবৈষম্য বোঝাতেই কি তিনি এমন সাদায়-কালোয় যুদ্ধ ঘোষণার কথা ভেবেছিলেন? নাকি সাদা এবং কালোর মধ্যে যে চিরন্তন দ্বন্দ্ব আছে, তাকেই কেন্দ্র করে তাঁর এহেন রঙের নির্বাচন? এ প্রশ্নের পাকা উত্তর নেই। তবে নানা সম্ভাবনার আভাস খেলা করে এই রং নির্বাচনে। তবে সেকালে এই খেলার নাম ছিল ‘চতুরঙ্গ’। হাতি, রথ (যানবাহন অর্থে),অশ্বারোহী এবং পদাতিক সেনা। এই চারটি স্তরের সমন্বয়ে খেলার নাম ছিল চতুরঙ্গ! যুদ্ধের যাবতীয় সাজসজ্জা থাকল, থাকল নিখুঁত রণনীতিও। তাই রাবণের মতো যুদ্ধবাজদের ঘরে আটকে রাখতে এই ছিল মন্দোদরীর কিস্তিমাত করা একটি চাল।
এই গেল মৌখিক ইতিহাসের কথা। উত্তর ভারতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসনকালে খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে দাবা খেলার সূচনা হয়। তারপর এটি পারস্য এবং তারপর দক্ষিণ ইউরোপে ছড়িয়ে যায়। আর, সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে সংস্কৃত গ্রন্থে দাবার উৎপত্তির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। দাবার প্রচলন নিয়ে আছে এমনই অসংখ্য মিথ। প্রকৃত ইতিহাস যাই-ই হোক না কেন, দাবার চালে ভারত বিশ্বকে মাত দিতে পারে, তা ১৮ বছর বয়সেই প্রমাণ করে দিয়েছেন গুকেশ।