সরস্বতীর মন্দির সেভাবে চোখে পড়ে না গোটা দেশেই। অথচ এই বাংলাতেই রয়েছে দেবীর এক মন্দির, যার বয়স পেরিয়েছে একশো বছর। যে বাংলার সারস্বত চর্চা সমীহ আদায় করেছে গোটা বিশ্বেই, সেই বৌদ্ধিক চর্চার সাক্ষ্যই যেন বহন করছে প্রাচীন এই সরস্বতী মন্দির। বীণাপাণি মন্দির দর্শন করে এসে সে ইতিহাস জানালেন শুভদীপ রায়।
সরস্বতী বিদ্যেবতী। দেবী জ্ঞানের প্রতীক। মাঘ মাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে দেবীর কাছে করজোড়ে সকলে প্রার্থনা করেন, অঞ্জলি দেন। অথচ দেবীর প্রতিষ্ঠিত মন্দির তেমনভাবে চোখে পড়ে না। বলা ভালো, সরস্বতী মন্দির রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি। এই বাংলাতে অবশ্য সরস্বতী আরাধনার মন্দির আছে, যা শতাব্দীপ্রাচীন। হাওড়া জেলার সেই মন্দিরকে বাংলার প্রাচীনতম সরস্বতী মন্দির বলেই চিহ্নিত করা হয়।
হাওড়া স্টেশন থেকে মন্দিরে দূরত্ব খুব বেশি নয়। বাস বা যে কোনও গাড়িতে মিনিট পনেরো গেলেই পঞ্চাননতলা। বাসস্টপ থেকে একটু এগোলেই ‘উমেশচন্দ্র দাস লেন’। মিনিট কয়েক সেই গলি বরাবর হাঁটলেই চোখে পড়বে মন্দিরের চূড়া। একেবারে উপরে একটা ত্রিশূল। তবে এই মন্দিরই যে দেবী সরস্বতীর, তা সহজেই বোঝা যাবে মন্দিরের চূড়াটা খেয়াল করলেই। হাঁস আর বীণা খোদাই করা এই চূড়াই যেন বহুদূর থেকে দেবীর অবস্থান ঘোষণা করছে। আর চূড়াটি রেঙেও উঠেছে দেবীর প্রিয় রং বাসন্তীতে। বলার অপেক্ষা রাখে না এই তিনটিই দেবীর সরস্বতীর সঙ্গে সম্পর্কিত।
প্রাচীন এই মন্দির একটি বাড়ির সঙ্গেই সংলগ্ন। দরজায় সকলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে লেখা ‘স্বাগতম’। এই বাড়ি উমেশচন্দ্র দাসের। যে-পথ ধরে সরস্বতীর কাছে আসা, সেই পথটিও তাঁরই স্মৃতি বহন করছে। এক সময় এলাকার বিখ্যাত মানুষ ছিলেন উমেশচন্দ্র। নিজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। দেশ আর দশের উন্নতিই ছিল তাঁর সাধনা। তাঁর বাড়িতেই প্রতিষ্ঠিত দেবী বীণাপাণি। উমেশচন্দ্র দাসের পরিবারই একশো বছরের বেশি সময় ধরে দেবী সরস্বতীর নিত্যপূজার দায়িত্ব সামলে আসছেন। তবে, সরস্বতী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা উমেশচন্দ্র করে যেতে পারেননি। সেই কাহিনি খানিক আলাদা।
পরিবারের সদস্যদের মুখেই শোনা গেল দেবীর অধিষ্ঠানের গল্প। শিক্ষার সরস্বতী-ধারা তখন বইছে দাস পরিবারে। উমেশচন্দ্রের মেজো ছেলে রণেশচন্দ্র দাস ছিলেন ইঞ্জিনিয়র। কর্মসূত্রে তাঁকে রাজস্থানে যেতে হয়। সেখান থেকে মায়ের নির্দেশে নিয়ে আসেন শ্বেতপাথরের সরস্বতী মূর্তি। মন্দিরের ভিতরে থাকা একটি ফলক এই ঘটনার সাক্ষ্য দিচ্ছে। সে-ফলকে লেখা,
জনকের ছিল মনে মন্দির স্থাপনা।
মাতার আদেশে তাঁর সুত চারি জনা।।
মন্দির স্থাপিলা আজ মনের হরষে।
বীণাপাণি পূজিবারে করিয়া মানসে।
এই ফলকের নিচে খোদাই করা তারিখটি হল, ১৯১৯ সালের ২০ মার্চ। অর্থাৎ মন্দিরের সূচনা সে-বছরই। ফলক আরও জানাচ্ছে যে, উমেশচন্দ্রের মনেই এই মন্দির স্থাপনের বাসনা ছিল। পরে, মায়ের আদেশ শিরোধার্য করে বাবার স্মৃতিতে সেই মন্দিরের সূচনা করেন তাঁর সন্তানরা। এই দিনটিকেই মন্দির প্রতিষ্ঠা সূচনাদিন হিসাবে ধার্য করা যেতে পারে। কেননা ফলক জানাচ্ছে,
পিতা উমেশ চন্দ্রের স্মরণের তরে।
স্মারক প্রস্তরখানি রাখিল মন্দিরে।।
অনুমান করা যায় স্মারক-প্রস্তর স্থাপনের পর মন্দির তৈরির কাজ শেষ হতে আরও কয়েক বছর সময় লেগেছিল। সেই হিসাব মিলিয়েই, মন্দিরের গায়ে থাকা অন্য ফলকে প্রতিষ্ঠার সময় হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে ১৯২৩ সালের স্নানযাত্রার দিনটিকে। ১৯১৯ বা ‘২৩- সূচনাকাল যাই ধরা হোক না কেন, এ মন্দিরের বয়স যে একশো পেরিয়েছে তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই। মন্দিরগায়ের অন্য ফলক তাই জানাচ্ছে, ২০২২ সালেই মন্দির শতবর্ষে পা দিয়েছে।
মাঝে ২০০১ সালে মন্দির নতুন করে সংস্কার করা হয়। তবে, বর্তমান মন্দিরের আদল একেবারে আগের মতোই রয়েছে। যেহেতু বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া মন্দির, তাই গর্ভগৃহ বা ঠাকুরদালানের নির্মাণও অনেকটা বাড়ির আদলেই। গর্ভগৃহে অধিষ্ঠিত মূর্তির পিছনেও একটা দরজা দেখা যায়। দু-বেলা ব্রাহ্মণ এসে দেবীর নিত্যপূজা সেরে যান। আর মাঘ মাসের শুক্লাপঞ্চমীতে হয় দেবীর বিশেষ পুজো। বলাই বাহুল্য, সরস্বতী পুজোর দিনে এই মন্দিরের জাঁকজমক হওয়াটাই স্বাভাবিক। সে নিয়মের প্রসঙ্গে আসছি। তবে আরও একটা দিন এই মন্দিরে বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা করা হয়। তা হল স্নানযাত্রার দিন। মন্দির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে প্রতি বছর পুজোর বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়।
আগেই বলেছি, রণেশচন্দ্র মূর্তি এনেছিলেন রাজস্থান থেকে। শ্বেতপাথরের সেই মূর্তিতে রাজস্থানি স্থাপত্যের ছাপও স্পষ্ট। মূর্তি উচ্চতায় প্রায় চারফুট। বাহন হাঁসের উপর দাঁড়িয়ে আছেন দেবী। বাঁ হাতে বীণা। দেবীর ঘাড়ও সামান্য বাঁ দিকে হেলানো। বিশেষ পুজোর দিনে মূর্তিটিকে ফুলের গয়নায় সাজানো হয়। পরিবারের সদস্যদের দাবি, এটিই চিরাচরিত প্রথা। সরস্বতী পুজোর দিনে বহুদূর থেকে ভক্তরা এসে ভিড় জমান এই মন্দিরে। পুজোর পর পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার ভিড়ও থাকে স্বাভাবিক ভাবেই। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেই জানা গেল পুজোর বিশেষ কয়েকটি নিয়মের কথা। এমনিতে প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহকে অন্নভোগ দেওয়ার চল রয়েছে। তবে হাওড়ার দাস পরিবারের সরস্বতী মন্দিরে অন্নভোগ দেওয়া হয় না। দেবীর বিশেষ ভোগ বলতে, বড় বাতাসা। যা নিয়ম করে ১০৮টা মাটির খুরিতে সাজিয়ে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে ক্ষীরের গুজিয়া, ফল এইসবও ওই খুরিতে থাকে। তা ছাড়া খই, মুড়কি, মিষ্টি তো রয়েছেই। পুজোর শেষে সকলের মধ্যে ওই ভোগ বিতরণ করে দেওয়া হয়।
সরস্বতী পুজো মূলত বিদ্যালয়গুলিতেই। তাই হয়তো দেবীর মন্দিরের কথা আমরা সেভাবে খেয়াল করেনি। তবে, এই বাংলাই তো নবজাগরণের ভূমি। এই বাংলার সারস্বত চর্চা সমীহ আদায় করেছে গোটা বিশ্বেই। প্রাচীন এই সরস্বতী মন্দির যেন বাংলার সেই শাশ্বত বৌদ্ধিক চর্চার সাক্ষ্যই বহন করছে সগৌরবে।