এআই দিয়ে ছবি তৈরি করলে নষ্ট হচ্ছে জল। মাত্র একটা ছবিতেই অন্তত কয়েক লিটার। তাও আবার এই গরমে। অথচ সোশাল মিডিয়া ভরেছে জিবলি আর্টে। সবই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কেরামতি। তাহলে এই এত ছবি কত জল নষ্ট করছে, ভাবুন তো!
কার লাভ? কার ক্ষতি? ভেবে দেখার প্রয়োজন নেই। ট্রেন্ড যখন, গা ভাসাতেই হবে। তাতে আর যাই হোক, নিজেকে কুল দেখানো যায়। একই বিষয় যে ট্রেন্ডে থাকবে এমন বালাই নেই। ইন্সট্যান্ট গ্রাটিফিকেশনের যুগে ট্রেন্ড বড়ই স্থায়ীত্ব বড়ই ক্ষনিক। তবে কিছু বিষয় নিয়ে চর্চা এতটাই চরমে পৌঁছয়, যে, গা না ভাসালেও সে সম্পর্কে খোঁজ না নিয়ে উপায় নেই।
সম্প্রতি জিবলি-র ছবি পোস্ট করাও এমনই এক ট্রেন্ড। বিশেষ কিছু করতে হবে না। যা করার এআই করবে। কাজ বলতে সেইসব ছবি সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করা। এটাই ট্রেন্ড। তা সেই ট্রেন্ড যত ট্রেন্ডিং হল, তা তলায় চাপা পড়ল অনেকগুলো বিষয়। যে শিল্পীর সারা জীবনের প্ররিশ্রমে এই শৈলীর গড়ে-ওঠা, তাঁর কথা মনে রাখার খুব একটা প্রয়োজন মনে করল না অনেকে। কেউ কেউ আপত্তি তুলল ঠিকই, তাতে স্বভাবত কর্ণপাত নেই। শিল্পীরাও পাল্লা দিয়ে গা ভাসালেন। বিশেষ করে যারা সবসময় পাইরেসির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, তাঁরাও। সেই নিয়ে বিতর্ক, পালটা বিতর্ক অনেক কিছুই হল। আখেরে লাভের লাভ কিছু হল না। বরং এআই-এর কেরামতিতে জিবলিতে আরও মেতে উঠল সবাই। অথচ এই কিছুদিন আগে অবধি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের কাজ কেড়ে নেবে, এমন চিন্তায় অনেকেই ভাবিত ছিলেন। সেই নিয়ে আলোচনাও কম হয়নি। এখন সেই এআই একটি শিল্পশৈলী আত্মসাৎ করে নিজেকে উন্নত করছে। মজার বিষয় তা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন মনে করছেন না সমাজের বড় একটা অংশ। বরং সেই আগুনে হাওয়া দিয়ে চলেছে তাদের শখ।
এসব নাহয় নীতি নৈতিকতার বিষয়। আজ যা ট্রেন্ডিং, কিছুদিন পর হয়তো আর থাকবে না। তখন আর শিল্প, শিল্পী, অধিকার, নৈতিকতা এসব নিয়ে আলোচনাও হবে না। কিন্তু সাম্প্রতিক জিবলি ট্রেন্ড পরিবেশের যে মারাত্মক ক্ষতি করে যাচ্ছে, তা ভাবার মতো বিষয় অবশ্যই। কি ভাবছেন এআই-এর সাহায্যে কেউ শখের ছবি বানালে পরিবেশ কেন প্রভাবিত হবে? আন্তর্জাতিক গবেষণায় চোখ রাখলেই সে খোঁজ মিলবে। শুধু জিবলি নয়, এআই-এর ব্যবহারই মারাত্মক প্রভাব ফেলছে পরিবেশে। বিশেষ করে জিবলির নাম নেওয়ার কারণ, ব্যাপকতা। মানে সাধারন কোনও লেখা বা তথ্য খুঁজে দেওয়ার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে যে পরিশ্রম করতে হয়, জিবলিতে ছবি তৈরির জন্য তার কয়েকগুন বেশি পরিশ্রম। ব্যাপারটা খুলেই বলা যাক।
স্রেফ একটা দিক নয়, নানাদিক দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিবেশের ক্ষতি করছে। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষণা বলছে ১০০ শব্দের কোনও চিঠি লিখতে ৫১৯ মিলিলিটার জল খরচ করে এআই। শুনে খুবই সামান্য মনে হতে পারে। কিন্তু এই পরিমাণটাই কোনও ছবি তৈরির সময় কয়েকগুণ হয়ে যায়। জিবলির কথাই ধরা যাক, গবেষকরা জানাচ্ছেন, একবার স্মার্টফোন চার্জ হতে যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন, প্রায় তার সমান শক্তি দরকার হয় একটি জিবলি স্টাইল ছবি তৈরি করতে। তাহলে ভেবে দেখুন তো, এইআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি কয়েক মিনিটের একটা সিনেমার দৃশ্য তৈরি করা হয়? আস্ত একটা জলাশয় পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হতে পারে। প্রশ্ন উঠতেই পারে কেন এত জলের প্রয়োজন?
আসলে, যেখান থেকে এআই-এর প্রযুক্তিগত বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করা হয় সেখানে বড় বড় মেশিনের ছড়াছড়ি। তাই সেখানে জলের ব্যবহার মারাত্মক। ঘুরিয়ে বললে, এআই-এর ব্যবহার যত বাড়বে তত প্রয়োজন হবে জলের। উধাও হবে একের পর এক জলাশয়। বিশ্বব্যপী এআই প্রযুক্তি যা জল ব্যবহার করে তা ডেনমার্কের মতো দেশের সামগ্রিক জল ব্যবহারের ছয় গুণ। অথচ ডেনমার্ক ছোটখাটো কোনও দেশ নয়। হিসাব বলছে সেখানকার বাসিন্দার সংখ্যা অন্তত ৬০ লক্ষ। এত সংখ্যক মানুষ সারাদিনে যা জল ব্যবহার করেন তার কয়েকগুণ জল খরচ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ইলেকট্রিসিটি ব্যবহারও মাত্রাতিরিক্ত। তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে প্রচলিত পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়, বলাই বাহুল্য। সুতরাং সাধারন শখপূরণ কিংবা ট্রেন্ডে ভেসে থাকার জন্য পরিবেশের এমন ক্ষতি না জেনেই করে ফেলছি আমরা। তাতে কার লাভ, কার ক্ষতি প্রশ্নের প্রয়োজন রয়েছে, তা করাও হচ্ছে না, সমাধানও মিলছে না।