বাংলা ভাষায় প্রবাদের ছড়াছড়ি। ‘রথ দেখা কলা বেচা’ এমনই একটি প্রবাদ। কিন্তু কীভাবে এই প্রবাদের জন্ম হল? রথযাত্রার আবহে জেনে নিন এই গল্প।
রথ দেখাও হল, সঙ্গে কলা বেচাও। অর্থাৎ এক সুযোগে দু-দুটি কাজ করে ফেলা। কথাটা তো দিব্যি চেনা, তাই না? আপনারাও নিশ্চয়ই কখনও না কখনও দরকারমতো এই প্রবাদটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কোথায় রথ দেখার আনন্দ, আর কোথায় কলা বেচার হিসেবি কাজ! দুয়ের মধ্যে তো কোনও মিলই নেই। তাহলে এই দুরকম কাজকে একসঙ্গে জুড়ে দেওয়ার মানে কী? সে কথাই বলা যাক বরং।
‘রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধুমধাম’… আষাঢ় মাসের নাম শুনলেই যে উৎসবের কথা মনে পড়ে, তার নাম রথযাত্রা। পুরীর রথ নাহয় বেশ দূরের ব্যাপার, কিন্তু রথ উপলক্ষ্যে বাংলার নিজেরও কম আয়োজন নেই। তার মধ্যে দুটো জায়গার নাম সবারই চেনা। যাঁরা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের পাতা উলটেছেন কোনও না কোনও সময়, তাঁদের মনে পড়বেই, ‘রাধারাণী নামে এক বালিকা মাহেশে রথ দেখিতে গিয়াছিল’…। তারপর সেই ছোট মেয়েটির হারিয়ে যাওয়া, আর সেখান থেকে গল্পের পর গল্প। ঠিক ধরেছেন, আমরা বলছি সাহিত্যসম্রাটের বিখ্যাত উপন্যাস ‘রাধারাণী’-র কথা। অন্য কোনও ভাবে না হোক, এই সূত্রে মাহেশের রথের নাম শুনেছেন অনেকেই। আর অনেকে এটাও জানেন, বঙ্কিমচন্দ্রের নৈহাটির বাড়ির লাগোয়া রাধাবল্লভ জিউ-র মন্দিরেও দাঁড়িয়ে থাকে একটি রথ। প্রতিবছর রথের দিনে তাতে চড়েই বেড়াতে বেরোন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা। বেশি দূর নয় অবশ্য, ঘরের কাছে মাসির বাড়ি অব্দিই গন্তব্য তাঁদের।
মাহেশের রথই হোক কি নৈহাটির, রথযাত্রায় একটি প্রথা মেনে চলেন ভক্তরা। দেবতাকে তাঁরা উৎসর্গ করেন কলা আর পান। নৈহাটিতে এর সঙ্গে থাকে ছোট ছোট মোড়কে রাখা চিনি। পানের মতো হালকা জিনিস ছুঁড়লে তা রথের ওপরে থাকা দেবমূর্তির কাছে পৌঁছোবে না, এই আশঙ্কা থেকেই সম্ভবত কলা জড়িয়ে পান ছোঁড়ার চল হয়েছিল। আর বুঝতেই পারছেন, দেবতাকে যদি কিছু উৎসর্গ করতে হয়, তবে আগে তো তা কিনতে হবে। সুতরাং রথযাত্রা ঘিরে যেসব জিনিসের বেসাতি চলে, কলা সেখানে থাকবেই।
ভাবছেন তো, এতরকম ভালো ভালো খাবার জিনিস থাকতে খামোখা মুখশুদ্ধির পান কেন?
আসলে ভারতের প্রায় সর্বত্রই প্রথা আছে, অঞ্চলের প্রধান শস্য দেবতাকে উৎসর্গ করা হয়। মাহেশ যে অঞ্চলে, সেই শ্রীরামপুরের কাছে পান চাষ হয় বিপুল পরিমাণে। একে তো অঞ্চলের প্রধান ফসল, তায় অর্থকরী, সুতরাং দেবতাকে পান না দিলে হয়! শ্রীরামপুরের রথ থেকেই ‘রথ দেখা কলা বেচা’ প্রবাদটির জন্ম হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
তাহলে? শুনতে যতই খাপছাড়া লাগুক না কেন, দেখলেন তো, রথ আর কলা দুই-ই হাজির। এরপর কেউ ‘রথ দেখা কলা বেচা’ বললে তাকে এসব গল্প শুনিয়ে চমকে দিতে পারেন কিন্তু!