‘আল্লা ম্যাঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই’- আব্বাসউদ্দিনের সেই গান কে শোনেননি! কিন্তু কেবল বাংলা গানে নয়, বাস্তবেও বৃষ্টির প্রার্থনায় একাধিক ব্রত আচার অনুষ্ঠানের চল রয়েছে এই বাংলায়। আর শুধু বাংলায় কেন, গোটা দেশ জুড়েই পালিত হয় এই জাতীয় বিভিন্ন প্রথা। কোথাও ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া তো কোথাও গণহারে বনবাসে যাওয়া- আশ্চর্য করে এই লৌকিক আচারগুলি। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
বৃষ্টির কামনা করে বাংলার গ্রামে গ্রামে বসুধারা ব্রত পালন করত মেয়েরা, যার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আলপনায় আটটি তারা এঁকে, আটটি ফুল দিয়ে মেয়েরা মন্ত্র পড়ত- “অষ্টবসু অষ্টতারা তোমরা হলে সাক্ষী/ আট দিকে আট ফুল আমরা রাখি।” মাটির ঘটে ফুটো করে বৃষ্টির অনুকরণে গাছের মাথায় জল ঢেলে গঙ্গা বরুণ ইন্দ্র চন্দ্র প্রমুখ দেবতার কাছে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা জানাত ব্রতকারিণী মেয়েরা। আসলে কৃষিই ছিল এই বাংলার মূল জীবিকা। তাই বৃষ্টির জন্য প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করার রীতি বহু প্রাচীন। স্থানভেদে কেবল বদলে বদলে গিয়েছে প্রার্থনার ধরনধারণ, রীতিনীতি।
আরও শুনুন: ভূরিভোজে সন্তুষ্ট করতে হবে জামাইকে… কোথা থেকে এল এই জামাইষষ্ঠীর রীতি?
যেমন ধরা যাক, গঙ্গার তীরে থাকা মালদহ জেলার কথা। বৃষ্টির কামনায় এখানকার বিভিন্ন এলাকায় ‘গাছহিংড়ি’ নামে একটি প্রথা পালন করা হত। মামার বাড়িতে জন্মেছে এমন একটি বাচ্চা ছেলে এই ব্রতের হোতা। উলঙ্গ অবস্থায় সবার আড়ালে একটি গাছের কাণ্ডে ছোট্ট কুঠুরি তৈরি করে সেখানে হিং পুরে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে তার উপর। ‘নোড়াপোঁতা’ উৎসবে আবার পাড়ার সবথেকে ঝগড়ুটে মহিলার বাড়ি থেকে চুরি করা নোড়া পুঁতে দেওয়া হয় অন্য বাড়ির উঠোনে। সকলের বিশ্বাস, নোড়া না পেয়ে মহিলা ঝগড়া করলে তা শুনে মেঘ রেগে গিয়ে বৃষ্টি দেবে। আবার এই এলাকারই অনেক গ্রামে অনাবৃষ্টি হলে বরুণদেবকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে ‘সাতঘরিয়া’ খেলায় মেতে ওঠে জনতা।
আরও শুনুন: না ডাক্তার, না ছুরিকাঁচি! প্রশান্ত মহাসাগরের বুকেই সন্তানের জন্ম দিলেন মহিলা
কর্ষণের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক টানা হয় সারা পৃথিবীতেই। নারীর ঋতুচক্র যেমন সন্তানজন্মের ইঙ্গিত বহন করে, তেমনই বৃষ্টিপাত হলেই মাটি ভরে উঠবে ফসলে- এই দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক কল্পনা করা হয়। আর সেই কারণেই অনেক অঞ্চলেই বৃষ্টি নামানোর ভার পড়ে মহিলাদের উপরে। যেমন উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি নামানোর জন্য ‘মেঘপরব’ বা ‘হুদুমদেও’ উৎসব উপলক্ষে মেঘ-এর পুজো করা হয়। রাতের আঁধারে কোনও নির্জন প্রান্তরে মশাল জ্বালিয়ে পুজো শুরু করে মেয়েরা। আবার উত্তরপ্রদেশেও রাতের আঁধারে জমিতে লাঙল দেয় নগ্ন মেয়েরা। কল্পনা করা হয়, তাদের দেখে রেতঃপাত হবে বৃষ্টির দেবতার, আর তার ফলেই নামবে বৃষ্টি।
তেলেঙ্গানার একাধিক গ্রামে আবার ত্যাগের মাধ্যমে দেবতাকে তুষ্ট করার পথে হাঁটেন গ্রামবাসীরা। ঘরবাড়ি ছেড়ে একদিন বনে কাটানোর মধ্যে দিয়ে প্রতীকী বনবাস পালন করেন তাঁরা। আর বৃষ্টি নামলে পরে দেবতাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য বোনালু উৎসব পালন করেন হায়দরাবাদের মানুষ। সারা মুখে রং মেখে, গলায় ফুলের মালা পরে শোভাযাত্রায় বেরিয়ে পড়েন তাঁরা।
বরুণ কিংবা শিবের পুজো করে বৃষ্টি কামনার প্রথা রয়েছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। বরুণ যজ্ঞের পুরোহিতরা জলে ডুবে থেকে এক হাজার বার বরুণের নাম জপ করেন। উত্তর বিহারে আবার মানুষ বিশ্বাস করেন, যজ্ঞের ধোঁয়ায় মেঘের চোখে জ্বালা করবে। আর তখনই মেঘের কান্নার জল ঝরে পড়বে বৃষ্টি হয়ে।
বৃষ্টির কামনায় গোটা দেশে যত প্রথা প্রচলিত আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত প্রথাটি বোধহয় দুটি পশুর বিয়ে দেওয়া। মহারাষ্ট্র, আসাম, বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে সম্পূর্ণ হিন্দু রীতি মেনে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া হয়। কর্নাটকে আবার এই বিয়ে হয় দুটি গাধার মধ্যে। দুই প্রাণীর মিলন যে বৃষ্টি ডেকে আনবেই, এ কথাই বিশ্বাস করেন সেখানকার স্থানীয় মানুষেরা।