এ জলের রং দুধে আলতার মতো। দেখলে মনে হবে, কেউ রং ঢেলে দিয়েছে হ্রদের জলে। কেউ বা ভেবে বসেন, এ নির্ঘাত ফটোশপের কামাল। কিন্তু সেসব কিছুই নয়। প্রকৃতির নিয়মেই এ জলের রং টকটকে গোলাপি। কী ভাবে এই হ্রদের জলের রং এমন আশ্চর্য? শুনে নিন সেই গল্পই।
না, কারওর হাত থেকে ভুল করে আলতার শিশি মোটেও উল্টে যায়নি এই হ্রদের জলে। তা সত্ত্বেও এ জলের রং এমন দুধে-আলতা। না, মনের ভুল একেবারেই নয়ই। অবিশ্বাস্য হলেও, এমন হ্রদ সত্যিই রয়েছে এই পৃথিবীতেই।
কোথায় ভাবছেন তো?পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ উপকূলের কাছে রয়েছে গোল্ড-এস্পারেন্স অঞ্চল। সেখানেই রয়েছে একগুচ্ছ হ্রদ, যাকে স্থানীয়রা বলেন বে অব আইজল। তার মধ্যেই রয়েছে এমন বাবল গামের মতো দেখতে একটি হ্রদ, যার নাম লেক হিলিয়ার।
হিলিয়ার শব্দের অর্থ উপশম। সত্যি বলতে, এই হ্রদের রং এমনই, যা চোখকে আরাম আর মনকে উপশম দিতে বাধ্য। এই হ্রদের নাম হয়েছে সেখান থেকেই। দু-হাজার ফুট লম্বা এই হ্রদ সত্যিই প্রকৃতির এক আশ্চর্য। সাদা বালি আর সবুজ জঙ্গল, সব মিলিয়ে রঙের বন্যা। মনমাতানো এই হ্রদ দেখতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন পর্যটকেরা।
আরও শুনুন: বর্ষা এলেই জেগে ওঠে কয়েক হাজার উপহ্রদ, ব্রাজিলের ‘বিস্ময় মরুভূমি’ ডাক পাঠায় পর্যটকদের
১৮০২ সালে ব্রিটিশ নাবিক ম্যাথু ফ্লিন্ডারস অভিযানে বেরিয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন এই গোলাপি হ্রদটিকে। পাহাড়ের উপর থেকে এই উজ্জ্বল দ্বীপটিকে দেখে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিলেন ম্যাথু। তিনি নাবিকের পাশাপাশি ছিলেন একজন মানচিত্রপ্রণয়ক। প্রথমে ভেবেছিলেন, বর্ণহীন জলের বুকে প্রতিফলনের জন্যই এমন রং ধারণ করেছে হ্রদটি। তবে তিনি ওই জল একটি বোতলে ভরে দেখেন, জলের রং বাস্তবেই গোলাপি। ওই অভিযানে এক সহযাত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। তাঁর নামেই ওই হ্রদের নাম রাখেন ম্যাথু। তবে পরে এই হ্রদ লেক হিলিয়ার বলেই বেশি খ্যাত হয়।
পরে বহু বিজ্ঞানী এই হ্রদের জল নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। তার থেকে জলের রং নিয়ে নানা ধরনের সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছেন গবেষকেরা। কেউ বলেছেন, ডিউনেলিয়েলা স্যালাইনা নামক বিশেষ এক ধরণের মাইক্রোঅ্যালগির সঙ্গে হিলোফিলিক ব্যাকটিরিয়ার যৌথ বসবাসের কারণেই এ হ্রদের রং এমন গোলাপি। লেক হিলিয়ারের লবনাক্ত জলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে একধরণের ক্যারাটেনয়েড রঞ্জক উৎপাদন করে ওই ব্যাকটিরিয়া। যা হ্রদের জলের রংটাই বদলে দেয়। গাজরে যে ধরনের ক্যারাটেনয়েড রঞ্জক দেখা যায়, এটাও অনেকটা ঠিক তেমনই। সাঁতার কাটা বা জলে পা ডোবানো নিয়ে কোনও বিধিনিষেধ নেই এ হ্রদের জলে। তবে এ হ্রদের জল পান করার উপযোগী নয় একেবারেই। বিশ শতকের দিকে নুন ও খনিজ তোলা হত এই হ্রদটি থেকে।
আরও শুনুন: ভারতেই আছে এক ‘পাকিস্তান’… অবাক হচ্ছেন! এই মুলুকের ঠিকানা জানেন?
আসলে হ্রদের নিচে যে কী রহস্য লুকিয়ে রয়েছে, তার সঠিক হদিস আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি কেউই। নানা রকমের গবেষণা, গল্প চলে। আর গোলাপি হ্রদের জল চোখ জুড়ায় পর্যটকদের। এ হ্রদের নামই যে উপশম। সমস্ত ধরনের রোগের দাওয়াই রয়েছে এ হ্রদের সৌন্দর্যে। দুঃখী, ক্লান্ত এ হ্রদ দেখে খুঁজে পান আরাম, শান্তি। নীল-সবুজের খেলার মাঝখানে এই গোলাপি হ্রদ যেন একটুকরো বিস্ময়।