এ যেন এক রূপকথার গল্প। কোনও অতিমানবিক শক্তি নয়, মানুষের ইচ্ছার জোরেই কেমনভাবে ভেঙে যেতে পারে সব বাধার পাহাড়, তারই গল্প। বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার পরেও উঠে দাঁড়ানোর গল্প। হ্যাঁ, তেমনই এক গল্প শোনান ইউপিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অরুণা এম। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সেই আশ্চর্য উত্থানের গল্প।
এককালে শিক্ষা বাবদে ঋণ শোধ করতে না পারায় আত্মঘাতী হয়েছিলেন বাবা। আর বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই নিজের স্বপ্নকে বদলে নিয়েছিলেন মেয়ে। আর্থিক টানাপোড়েন, পাঁচ ভাইবোনের পড়াশোনা চালাতে অনিশ্চয়তা, এমনকি বাবার এহেন অপঘাত মৃত্যু- কোনও কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি তাঁকে। অদম্য মনের জোরে শেষমেশ সাফল্যের মুখ দেখেন কর্ণাটকের মেয়ে অরুণা এম। ২০২১ সালের ইউপিএসসি পরীক্ষায় তিনি নিজে তো উত্তীর্ণ হন বটেই, পাশাপাশি গ্রামের মেধাবী পড়ুয়াদের এই সর্বভারতীয় পরীক্ষার উপযোগী সহায়তা দেওয়ার জন্য খুলে ফেলেন একটি কোচিং ইনস্টিটিউটও।
আরও শুনুন: পুরুষদের কাজ আবার কী! বাড়ির বাধা উড়িয়ে গাড়ির মেকানিক হয়েই স্বপ্নপূরণ তরুণীর
কিন্তু খুব একটা সহজ ছিল না অরুণার চলার পথটা। সত্যি বলতে কি, দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক স্তরে পৌঁছনোর জন্য যে ইউপিএসসি পরীক্ষাটির আয়োজন করা হয়, তাতে উত্তীর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে একাগ্র থাকেন পরীক্ষার্থীরা। কিন্তু অরুণা এই পরীক্ষায় বসার কথাই ভাবেননি কখনও। বরং তাঁর লক্ষ্য ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। কিন্তু কর্নাটকের টুমকুর জেলার এই মেয়েটির জীবন হঠাৎই বদলে গিয়েছিল বাবার অকালমৃত্যুতে। ২০০৯ সালে তিনি যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন, সেই সময়েই আত্মহত্যা করে বসেন তাঁর বাবা। পাঁচ ছেলেমেয়ের পড়াশোনার জন্য নেওয়া ঋণের বোঝা আর টানতে না পেরেই এই ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে সংসার চালানোর জন্য পড়া ছেড়ে কাজে যোগ দিতে বাধ্য হন অরুণার দুই বড় দিদি। কিন্তু এই মেয়েটি তখনই ঠিক করে নিয়েছিলেন, বাবার স্বপ্ন পূরণ করবেন তিনি। যে কোনও সাধারণ চাকরি নয়, সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দিতে হবে তাঁকে- এমনটাই সেদিন মনে করেছিলেন অরুণা। তাই এবার জীবনের পথটাই বদলে যায় তাঁর। তাঁর বাবা চাইতেন মেয়েরা যেন ইউপিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। সেই কথা মনে রেখেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন তিনি।
আরও শুনুন: এককালে শিকার হয়েছিলেন গৃহহিংসার, এখন তিনিই পুলিশ হয়ে পথ দেখাচ্ছেন নির্যাতিতাদের
কিন্তু জীবন তো আদতে রূপকথা নয়। নয় রুপোলি পর্দার স্ক্রিপ্টও। তাই পলক ফেলতে না ফেলতেই স্বপ্নপূরণ হয়ে যায়নি অরুণার। উলটে পাঁচ-পাঁচবার হেরে যান তিনি। অকৃতকার্য হন ইউপিএসসি পরীক্ষায়। কিন্তু জীবনটা আদতে সিনেমার মতো নয় বলেই, এখানে হিরো হতে পারে সেই মানুষেরাই, যারা হেরে যায় না। অরুণাও হেরে যাননি। বেঙ্গালুরুতে নিজের একটি অ্যাকাডেমি খুলে ফেলেন তিনি, যেখানে গ্রাম থেকে উঠে আসা মেধাবী পড়ুয়াদের ইউপিএসসি-র জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন। পাশাপাশি চলতে থাকে নিজের প্রস্তুতিপর্ব। অবশেষে, ২০২১ সালে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন অরুণা। অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সংরক্ষিত আসনে উত্তীর্ণ হতে চাননি তিনি। সকলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে অসংরক্ষিত আসনেই ইউপিএসসি-তে উত্তীর্ণ হন অরুণা।
তাঁর বাবার মতো অন্যান্য কৃষকদের সাহায্য করতে চান অরুণা। যাতে আর কাউকে তাঁর বাবার মতো দারিদ্র্যের জেরে আত্মহত্যা না করতে হয়। একটা লড়াই শেষ করে এবার সেই নতুন লড়াইয়ের পথেই পা বাড়িয়েছেন তিনি।