মাস্টারমশাইদের জায়গা নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সম্প্রতি কেরলে একটি স্কুলে ক্লাস নিয়েছেন এআই শিক্ষিকা। প্রযুক্তির যুগে, এই শিক্ষিকাকে যত ‘অ্যাডভান্স’ করে তৈরি করা যায়, তাই-ই করেছন নির্মাতারা। তিনি একাধিক বিষয়ে ক্লাস নিতে পারেন, অনেকগুলি ভাষা বলতে পারেন। এমনকী তাঁর উপস্থিতিও বেশ চমকপ্রদ, আধুনিক। ফলত পড়ুয়ারা একজনও ক্লাস ফাঁকি দেয়নি। কিন্তু এআই শিক্ষকের ‘জীবন’ কি আর পড়ুয়াদের কাছে নৈতিকতার পাঠ্যবই হয়ে উঠতে পারে!
মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি! ঠান্ডা গলায় বলা একটি চরিত্রের সংলাপ। সিনেমার পর্দা পেরিয়ে সেই সংলাপ ছড়িয়ে পড়েছে বাঙালি জীবনের নৈতিক পরিসরে। এ হুমকির লক্ষ্য তো ছিল একজন মাস্টারমশাই। অতএব মাস্টামশাই যে সব দেখছেন, সে কথা জানাই ছিল। আর সব দেখেও চুপ করে যাওয়া মানুষ নন মাস্তারমশাইরা। তাঁরা প্রতিবাদ করবেনই। কোনও আতঙ্কই তাঁদের কণ্ঠ রোধ করতে পারবে না। টাকা-রাজনীতি-ক্ষমতার খেলা তাঁদের ভয় পেত। তাই হুমকি দিয়ে ঠান্ডা করতে চেয়েছে।
মাস্টারমশাইরা এরকমই। তাঁরা শাসন করেন, সোহাগও করেন। তাঁরা যে শুধু বই ধরে ধরে শিক্ষা দেন, তা তো নয়। বইয়ের পড়ার বাইরে জীবনের যে শিক্ষা, নৈতিকতা আর মূল্যবোধের যে পাঠ, তা মাস্টারমশাইরা ছাড়া আর কে দিতে পারেন! সব থেকে বড় কথা, তাঁরা আপনি আচরি ধর্ম শিখিয়ে দেন শিরদাঁড়া সোজা রাখতে। ঠিক-কে ঠিক আর ভুল-কে ভুল বলার যে সাহস, তা সেই শৈশবেই দিয়ে দেন তাঁরা। সত্যি বলতে, এই সমাজে নীতি-নৈতিকতার আলাদা কোনও পাঠশালা নেই। মাস্টামশাইদের জীবনই সেই পাঠ্য, যেখান থেকে মাথা উঁচু করে বাঁচার শিক্ষা পায় মানুষ। মাস্টারমশাইওরা তাই অন্যায় কিছু দেখলে ক্ষমতাধারীদের তা মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠত। যা এই সমাজের জন্য হানিকর, তার সঙ্গে তাঁরা যে কিছুতেই আপোশ করবেন না, এ কথা অতিবড় ক্ষমতাধরও জানত। অতএব নেমে এসেছিল সেই বরফশীতল গলার হুমকি- মাস্টারমশাই কিন্তু আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি! কিন্তু সত্যিই কি দেখেননি! নাকি দেখেও চুপ করেছিলেন! বাঙালির কাছে এ উত্তর জানা। আর তাই পৃথিবী যতই বদলে যাক মাস্টামশাইদের প্রতি এখনও একই রকম সম্ভ্রম তোলা থাকে। এর খুব একটা বদল হয়নি।
-: আরও শুনুন :-
এ কথা ঠিক যে সময় যত বদলেছে তত সমাজের ভিতকার বুননেও এলোমেলো নানা চাপ এসেছে। মানুষের চরিত্ররাও সেই মতো বদলে বদলে গিয়েছে। ফলত মাস্টারমশাইরাও যে প্রত্যেকে ঠিক আগের মতোই আছেন, তা হয়তো জোর দিয়ে বলা যায় না। অনেক ঘটনাই ঘটে, যাতে এই সমীহের জায়গা যেন সাময়িক নড়ে যায়। তবু, মানুষ গড়ার, তথা সমাজ গড়ার কারিগর তাঁরাই। সেই মাস্টারমশাইদের জায়গা নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সম্প্রতি কেরলে একটি স্কুলে ক্লাস নিয়েছেন এআই শিক্ষিকা। প্রযুক্তির যুগে, এই শিক্ষিকাকে যত ‘অ্যাডভান্স’ করে তৈরি করা যায়, তাই-ই করেছন নির্মাতারা। তিনি একাধিক বিষয়ে ক্লাস নিতে পারেন, অনেকগুলি ভাষা বলতে পারেন। এমনকী তাঁর উপস্থিতিও বেশ চমকপ্রদ, আধুনিক। ফলত পড়ুয়ারা একজনও ক্লাস ফাঁকি দেয়নি। রোবট টিচারের ক্লাসে অ্যাটেনডেন্স খাতায় একটিও লাল দাগ নেই। এ তো খুব ভালো কথা। এমনিতে আমাদের বহু কাজ এখন প্রসুক্তির হাতেই। শিক্ষাদানের যে আনুষ্ঠানিক বিষয়গুলি, সেগুলিও আর আগের মতো নেই। প্রযুক্তি সেখানেও তজায়গা করে নিয়েছে। বিশেষত করোনাকালের স্তব্ধতা প্রযুক্তি আর শিক্ষাদানকে একটা সমীকরণে বেঁধে ফেলেছিল। এই অগ্রগতি নিয়ে বলার কিছু নেই, কেননা তাই-ই সময়ের ধর্ম।
তবে কিনা সময়টাও বড় বিদঘুটে। প্রতিনিয়ত চারপাশে এত জিনিস ঘটে যাচ্ছে, যাতে নীতি-ন্যায্যতার ধারণাগুলিই যেন রোজ টাল খাচ্ছে। মূল্যবোধ মিলিয়ে যাওয়া, অন্যায়ের সঙ্গে আপোশের প্রবণতাগুলো এত প্রকট হয়ে উঠছে যে, প্রতিদিন আরও প্রয়োজন হয়ে পড়ছে সেই সব মাস্টামশাইয়ের, যাঁরা সাহসী হওয়ার শিক্ষা দিতেন। সাদা আর কালোর ফারাক বুঝিয়ে শিখিয়ে দিতেন বহু হুমকি সত্ত্বেও কোনটির পক্ষে থাকতে হয়। জীবন যে সাময়িক লাভ-লোকসানের থেকে অনেক বড়, তা শুধু তাঁরা শেখাতেন না, নিজেদের জীবন দিয়েই দেখিয়ে দিতেন। প্রযুক্তি আমাদের এগিয়ে যেতে সহায়তা করছে। আমরা অ্যাডভান্স হচ্ছি। এইআই শিক্ষকের প্রচলন নিশ্চিত সেই অগ্রগতির দিকেই আর-এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু এআই শিক্ষকের ‘জীবন’ কি আর পড়ুয়াদের কাছে নৈতিকতার পাঠ্যবই হয়ে উঠতে পারে! অথচ এই বিপন্ন সময়ে সেটাই ছিল সবথেকে জরুরি।
প্রযুক্তি নির্মিত টিচারকে আর হয়তো বলতে হবে না যে, মাস্টামশাই আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি! আর সেখানেই ভবিষ্যতের জন্য খেদ হয়। প্রশ্ন জাগে, মাস্টামশাই সত্যি কি আপনি আর কিছুই দেখবেন না?