সোমনাথ মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ নতুন করে গড়ে তোলার পক্ষে সায় ছিল না জওহরলাল নেহরুর। ধর্মনিরপেক্ষ দেশে মন্দির গড়ার জন্য সরকারি তহবিল দেওয়া হবে কেন, এ প্রশ্নও তুলেছিলেন তিনি। যে ভারতে ধর্ম হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার, সেই ভারতে দাঁড়িয়ে ফিরে দেখা যাক পণ্ডিত নেহরুর সেই ভাবনাকে।
যে দেশ সংবিধানে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করেছে, সেই দেশে ধর্মের সঙ্গে সরকার কতখানি সংস্রব রেখে চলবে, এ প্রশ্ন নিয়ে রীতিমতো মাথা ঘামিয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। আর তাঁর সেই ভাবনাই স্পষ্টভাবে সামনে এসেছিল সোমনাথ মন্দিরের পুনর্নির্মাণ প্রসঙ্গে। ১৯৫২ সালে সোমনাথ মন্দিরের ধ্বংসস্তূপে ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করা নিয়ে কার্যত আপত্তিই জানিয়েছিলেন নেহরু। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা ঘিরে যে উৎসব শুরু হয়েছিল, তার সঙ্গেও হিন্দুত্ববাদের তুলনা টেনেছিলেন তিনি। আর সেই বিষয়টি আদৌ পছন্দ হয়নি তাঁর।
আরও শুনুন: এক দেশ এক আইন নয়, এক দেশ এক উন্নয়নের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন নেহরু
সত্যি বলতে, নানা ধর্ম ও নানা জাতির বাস যে ভারতে, সেই ভারতে বারে বারেই ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতির হাতিয়ার। আর সেই হাতিয়ার দিয়েই জাতি ধর্মের এই আলাদা অংশগুলোর মাঝে দাগ কাটার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশেই এই বিভেদের কুফল নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন নেহরু। তাই দেশকে একসূত্রে বাঁধার জন্য তিনি এমন কোনও নিরপেক্ষ সূত্রেরই সন্ধান করেছিলেন, যেখানে এই বিভেদগুলো কোনোভাবেই প্রকট হয়ে উঠবে না। পাশাপাশি, সেই স্বাধীন দেশে ধর্ম নিয়ে যে কোনও কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেই সতর্ক থাকতে চাইছিলেন নেহরু। সেই কারণেই, সোমনাথ মন্দিরের ধ্বংসস্তূপে যখন নতুন করে মন্দির গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে স্বচ্ছন্দ হতে পারেননি তিনি। ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, একটি ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনার দেশে সরকার কোনও একটি বিশেষ মন্দির নির্মাণে টাকা ঢালবে, এই বিষয়টিতে নারাজ ছিলেন নেহরু। পাশাপাশি সোমনাথ মন্দির ধ্বংসের প্রাচীন ইতিহাসকে সামনে নিয়ে এলে তা সাম্প্রদায়িক আবেগে উসকানি দিতে পারে, এমনটাও আশঙ্কা ছিল তাঁর। তাই, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ যখন ওই মন্দিরের শিলান্যাসে উপস্থিত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী নেহরু। সেই নিষেধ না শুনেই রাষ্ট্রপতি সেখানে যান এবং বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতাকেও নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন নেহরু। উপরন্তু, নতুন মন্দির না গড়ে ধ্বংসস্তূপ সংরক্ষণের পক্ষে সওয়াল করেছিল এএসআই। দেশের ইতিহাস রক্ষার যুক্তিতে সেই প্রস্তাবেই সায় ছিল নেহরুরও।
আসলে মন্দির বা কোনও ধর্মের চিহ্ন নয়, সদ্যস্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে নেহরুর যাবতীয় মনোযোগ ধাবিত হয়েছিল দেশের উন্নয়নের দিকেই। তাই তাঁর সাফ বক্তব্য ছিল, নদী বাঁধগুলিই হল আধুনিক ভারতের মন্দির। এমনকি ২০০১ সালে একটি আইটি পার্কের উদ্বোধনে সেই সুরেই কথা বলেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। যদিও মন্দির সংক্রান্ত মতাদর্শ নিয়ে নেহরুকে প্রায়শই বিঁধতে ছাড়ে না গেরুয়া শিবির, এমনকি রামমন্দিরের শিলান্যাসের আগেও সোমনাথ মন্দিরের প্রসঙ্গ তুলে সরব হয়েছিল আর.এস.এস। কিন্তু বাজপেয়ীও যখন দেশের উন্নয়নের চিহ্নগুলিকে দেশের মন্দির বলেন, তখন নেহরুর কথা নতুন করে ভাবতেই হয়। সদ্যস্বাধীন দেশে কেন মন্দির নিয়ে ওই মতাদর্শ জারি রেখেছিলেন পণ্ডিত নেহরু, সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখাও তাই প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।