নিজের ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে তাঁর এক কাকার কথা জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। সুকুমার রায়ের এই ভাইটি কোথাও বেড়াতে গেলে ট্রেনে ওঠার আগেই চলে যেতেন ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে। ইঞ্জিনের ধরন, তার প্রস্তুতকারী সংস্থার নাম ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য ডায়েরিতে না লেখা পর্যন্ত তাঁর শান্তি হত না। এমনকি যাত্রার শুরুতে সময় না পেলে, পরের কোনও স্টেশনে নেমে এই কাজটা সেরে আসতেন তিনি। আচ্ছা বলুন তো, ট্রেনে চড়লেও ট্রেনের বাইরের এইসব খুঁটিনাটি নিয়ে আমরা কখনও মাথা ঘামিয়েছি কি? আসুন, বরং শুনে নেওয়া যাক সেসব গল্পই।
প্রথমবার রেলগাড়িতে চড়তে গিয়ে ছোট্ট রবির ভয় হয়েছিল, সে যদি পড়ে যায়! রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণ থেকেই এ কথা জেনেছি আমরা। আর কেবল রবীন্দ্রনাথ কেন, অধিকাংশ নামী মানুষের লেখাপত্রেই রেলগাড়ি নিয়ে একটা নস্টালজিয়া থাকতে দেখা যায়। কিন্তু সেসব তো রেলগাড়ির অন্দরমহলের গল্প। ট্রেনের ভিতর, ভিতরের মানুষগুলো যেমন পালটে পালটে যায়, তেমনই ট্রেনের বাইরেটাও তো পালটে যায়। আসুন, বরং তাই নিয়েই শোনা যাক দু-এক কথা।
আরও শুনুন: এমন কুকুরও হয়! নিজের রক্ত দিয়ে ৬৪ ‘বন্ধু’র প্রাণ বাঁচাল তিন-পেয়ে সারমেয়
আচ্ছা, ট্রেনের কামরার গায়ে যে বিভিন্ন রঙের ডোরা কাটা থাকে, খেয়াল করে দেখেছেন সেগুলো? না, কেউ আপন খেয়ালখুশিতে রং দিয়ে আঁচড় কাটেনি ওখানে। একেক রঙের ডোরা আসলে একেক ধরনের কামরার বৈশিষ্ট্য বোঝায়। যেমন ধরুন, দূরপাল্লার ট্রেনে নীল রঙের কামরার গায়ে কখনও হলুদ, কখনও সাদাটে ডোরা কাটা থাকে। আসলে লাল বা নীল রঙের কোচের উপরে হলুদ ডোরা মানে বোঝায় ওই কামরাগুলি বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য বরাদ্দ। কেউ যদি যাত্রাপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁকেও রাখা হবে ওই কামরাতেই। আর নীলের উপরে সাদাটে রঙের ডোরা কী বোঝায়? আসলে ওই কামরাগুলি হল দ্বিতীয় শ্রেণির অসংরক্ষিত কামরা। যদি ধূসর রঙের উপরে সবুজ ডোরা দেখা যায়? তাহলে বুঝতে হবে ওই কামরাগুলি মহিলা যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত। আবার ধূসর রঙের উপরেই যদি থাকে লাল ডোরাকাটা? EMU বা MEMU ট্রেনের ক্ষেত্রে ওগুলি হল প্রথম শ্রেণির কামরা।
আরও শুনুন: Indian Railway: ভারতীয় ট্রেনে শৌচালয় চালু হয়েছিল বাঙালির সৌজন্যেই, জানেন?
শুধু বিভিন্ন রঙের ডোরাকাটাই নয়, আলাদা আলাদা ট্রেনের ক্ষেত্রে পালটে যায় গোটা কামরার গায়ের রংটাই। এমনিতে এক এক জায়গার লোকাল ট্রেনের কামরায় একেক রং, আবার দূরপাল্লার ট্রেনের আলাদা রং, এসব তো রয়েছেই। কিন্তু সব দূরপাল্লার ট্রেনকেও আবার একইরকম দেখতে হয় না। বিশেষ বিশেষ ট্রেনের জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে কিছু বিশেষ ধরনের রংওয়ালা কামরা। যেমন, রাজধানী গোত্রের ট্রেন হলে তার রং অবশ্যই লাল। আগে লাল রং কেবল রাজধানীর কামরা ছাড়া অন্য কোনও ট্রেনেই ব্যবহার হত না। শতাব্দী এক্সপ্রেসের কামরার রং আবার হালকা নীল, তার উপরে আর নিচে থাকে কিছুটা করে ধূসর অংশ। হামসফর এক্সপ্রেসের রংও হালকা নীল, তার উপরে রয়েছে আলপনার মোটিফ। দুরন্ত এক্সপ্রেসের রং অবশ্য সকলের থেকে আলাদা। কোনও একটিমাত্র রং নয়, একাধিক রং ছড়িয়ে রয়েছে এই ট্রেনের গায়ে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্বোধন করা, দেশের সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেন ‘বন্দে ভারত’-এর চেহারাটিও ঝকঝকে। ধাতব সাদা রঙের মাঝখানে একটিমাত্র নীল ডোরা নিয়ে ছুটে যায় এই ট্রেনটি। মোদির উদ্বোধন করা আরও একটি বিশেষ ট্রেন ‘তেজস’-এর চেহারাটি আবার তার নামের সঙ্গেই মানানসই। সূর্যরশ্মির কমলা হলুদ রং আর মাঝে মাঝে সূর্যের ছবি আঁকা রয়েছে দেশের সবচেয়ে আধুনিক ব্যবস্থাসম্পন্ন এই ট্রেনটির গায়ে।
আসলে রেল ব্যবস্থায় রং কেবল সৌন্দর্যবর্ধনের হাতিয়ার নয়। তা আদতে একেকটি সিগন্যাল বা প্রতীক। যাতে একনজর দেখেই যাত্রীরা কামরাগুলি চিনে নিতে পারেন, সেজন্যই এমন বিভিন্ন রঙে ট্রেনের কামরাগুলি সাজিয়ে রেখেছে বিশ্বের বৃহত্তম রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভারতীয় রেল।