বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে। যেসব প্রকল্প নিয়ে এ কথা মাঝে মাঝেই শোনা যায়, রেল তার মধ্যে একটি। কিন্তু জানেন কি, রেলযাত্রার গোড়ার যুগে আদতে বেসরকারিই ছিল এ পরিষেবা। কিন্তু তাতে লাভ হয়েছিল কি?
সরকারি প্রকল্পের অব্যবস্থা নিয়ে কথা উঠতেই থাকে সবসময়ে। এইসব প্রকল্পের সামনের তালিকাতেই হাজির রেল। সংকীর্ণ কামরা, টিকিটের দাম, দেরি করা, ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, এমন নানা কারণেই সে কাঠগড়ায় ওঠে। তার উপর জুড়েছে একের পর এক দুর্ঘটনা। সম্প্রতি কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আরও একবার সেইসব অব্যবস্থা আর ত্রুটিকে চোখের সামনে তুলে ধরেছে। তা নিয়ে কথা হওয়াই প্রয়োজন বইকি। কিন্তু এইসব ত্রুটির নিরিখে অনেকেই মনে করেন, হয়তো মালিকানা বদলে গেলেই পরিষেবার মানও বদলে যাবে। এমনিতেই, সরকারি কর্মীদের কাজে ঢিল দেওয়া নিয়ে বদনাম রয়েছে, সুতরাং সরকারি মালিকানার বদলে বেসরকারি মালিকানার কড়াকড়িতে যাত্রী পরিষেবা ভালো হবে বলেই আশা তাঁদের।
আরও শুনুন:
রেল দুর্ঘটনা থেকে মুক্তি পেতে অপেক্ষা করতে হবে ২২৭ বছর! কিন্তু কেন?
কিন্তু কথা হচ্ছে, রেলযাত্রার গোড়ার যুগে আদতে বেসরকারিই ছিল এ পরিষেবা। কিন্তু তাতে যাত্রীদের লাভ হয়েছিল, নাকি নিজেদের পকেট ভরানোর দিকেই বেশি নজর ছিল কর্তৃপক্ষের, তা নিয়ে তর্ক উঠতেই পারে।
সেটা ব্রিটিশ আমল। সেই সময়েই রেলগাড়ি এসেছিল এ দেশে। ১৮৪৯ সালে এ দেশের ঔপনিবেশিক সরকারের সঙ্গে চুক্তি সই করে দুটি রেলওয়ে কোম্পানি, ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে এবং গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে। অথচ মজার কথা হল, ইংল্যান্ডের রাজদরবারে প্রভাব খাটিয়ে দুই কোম্পানি প্রায় বিনামূল্যেই এই চুক্তি সম্পাদন করে ফেলে। চুক্তি মোতাবেক, সম্পূর্ণ প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জমি সরবরাহ করার দায়িত্ব পড়ে এ দেশের সরকারের উপর। ঠিক হয়, সরকার ওই জমি কিনে দেবে সংস্থাগুলিকে। যদি রেল চালাতে শুরু করে ঠিকমতো লাভ না হয়, এমনকি ক্ষতিও হয়, তাহলেও সংস্থা যেন মোট বিনিয়োগের ৫ শতাংশ হারে আর্থিক লাভ করে, তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। এমনকি কোনও সংস্থা কাজ বন্ধ করে দিতে চাইলে, সংস্থার বিনিয়োগ করা সব টাকাই সরকার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে। উপরন্তু, কোনও কাজের জন্যই সরকারের কাছে বাধ্য থাকবে না সংস্থাগুলি।
কিন্তু কেন এমন অভিনব অলাভজনক চুক্তিতে রাজি হয়েছিল সরকার? আসলে সেসময় শিল্পবিপ্লব ঘটে গিয়েছে। নতুন বাজারের খোঁজে পাগলের মতো ছুটছে সব শিল্প সংস্থা, একইসঙ্গে কাঁচামাল জোগাড়ের নতুন জায়গাও খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই দুই কারণেই চাই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। আর পণ্য বানানোর কাঁচামাল ও পণ্য বিক্রির বাজার, দুই-ই জোগাতে পারে উপনিবেশ। ফলে ভারতবর্ষে রেল চালু করার জন্য ইংরেজ দরবারে চাপ বাড়াচ্ছিল শিল্পপতিরা, যাদের সঙ্গে হাত মেলানো ছিল এই রেল সংস্থাদেরও। আদতে সবটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিজেদের মধ্যে লাভ বুঝে নেওয়ার হিসেবনিকেশ। ফলে, এ কথা বলাই যায় যে, রেলওয়ে আদৌ ব্রিটিশ সরকারের উপহার হিসেবে ভারতবর্ষে আসেনি। বরং ১৮৫০ থেকে ১৮৯৮, এই সময় জুড়ে প্রায় ১৩ কোটি পাউন্ড, অর্থাৎ ১০৫৬ কোটি টাকারও বেশি ভারত থেকেই গিয়েছে এই সংস্থাগুলির পকেটে। আর তারপরেও এই ব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। শিল্পপতি আর সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজনে যেখানে সেখানে রেললাইন পাতা হয়েছিল, আদৌ আমজনতার যাতায়াতের সুবিধার কথা সেখানে ভাবা হয়নি। মাল বহনের জন্য ইচ্ছেমতো চড়া দাম হাঁকত সংস্থাগুলি। তার সঙ্গেই ছিল ঘোরতর বর্ণবৈষম্য। সাহেব মেমদের জন্য আরামদায়ক কামরার ব্যবস্থা, আর কোনও সুযোগসুবিধা ছাড়া অপরিসর অপরিচ্ছন্ন কামরাতে ঠাসাঠাসি করে চড়তেন দেশীয় মানুষেরা। এমনকি কর্মীদের মধ্যেও বেশি বেতন ও সুযোগ জুটত কেবল সাহেবদের কপালেই।
আরও শুনুন:
মোদি সরকারের আমলে ৬০০ পেরোল রেল দুর্ঘটনা, কংগ্রেস যুগে সংখ্যাটা কত ছিল?
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, রেলগাড়ি তার শুরুর আদি পর্বে বেসরকারি থাকলেও, তার পরিষেবায় ত্রুটি কম ছিল না। আসলে সরকারি মালিকানা হোক কি বেসরকারি, ত্রুটিপূর্ণ পরিষেবার মূল কারণ তো কাজে অবহেলা। আর সেই অবহেলার দিকে প্রশ্ন তোলাটাই তাই সবার আগে জরুরি।