মানুষের পরলোকের বার্তাবাহক হল কাক। তাই হবিষ্যি -অন্ন সেবনে কাকের খোঁজ পড়ে। এতেই নাকি স্বর্গ পায় আত্মা। এর উল্টোটাও আছে। ভারতের বহু জায়গায় কাকের ডাককে অশুভ বলে মনে করা হয়। পাঞ্জাবে কাক যদি কোনও মহিলার রুমাল তুলে নেয় এবং ফেলে দেয়, তবে সেই রুমাল চলে যায় বাতিলের খাতায়। আসলে কাক নিয়ে মানুষের শুভাশুভবোধ বেজায় গোলমেলে।
কাকের কুচকুচে কালো রং, কর্কশ ডাক, শানিত নজর নিয়ে অনেক অভিযোগ মানুষের। সেই কাককেই আবার পবিত্র পাখি বলে মনে করে ভারতীয় সমাজ। উত্তর ভারতে কাকের প্রতি খাদ্য নিবেদনকে বলা হয় ‘কগৌর’। শাস্ত্র মতে, কাককে খাদ্য দেওয়ার পর মৃত ব্যক্তির আত্মা স্বর্গে প্রবেশ করতে পারে। এই কারণেই কাককে ‘বলিপুষ্ট’ ও ‘বলিভুজ’ বলা হয়। যার অর্থ উৎসর্গীকৃতি অর্ঘের খাদক।
মহাভারত যুদ্ধ তখন অনেকটা হয়ে গিয়েছে। কৌরবকুলে জীবীতদের অন্যতম দ্রোণপুত্র। একদিন তিনি দেখেন, একটি প্যাঁচা একটি কাককে হত্যা করছে, এর থেকে তিনি পাণ্ডবশিবির আক্রমণের ইঙ্গিত পান। রামায়ণে পাওয়া যায় দুষ্ট কাকের কাহিনি। সেই কাক সীতার পা দংশন করেছিল। ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ক্রুক কাক সংক্রান্ত একটি লেখায় বলেছেন, এককালে মধ্যভারতে এক শ্রেণির যাযাবর বসবাস করত, এরা নারায়ণের পূজক ছিল। মৃতদের সমাহিত করার পর সমাধির মাথার কাছে রাখত চাল, তেল ইত্যাদি দানসামগ্রী। সেই দানসামগ্রী যে পশু-পাখি খেতে আসত তাকেই তারা পুজো করত। মৃত সম্পর্কে তারা সবচেয়ে বেশি শুভ ইঙ্গিত পেত যখন সেই দান কাক খেতে আসত।
আরও শুনুন: বনদেবীর আরাধনা করেন অরণ্যের মানুষ, তবে সব পুজোই আসলে প্রকৃতি পুজো
গরুড় পুরাণেও রয়েছে কাক সংক্রান্ত পরলৌকিক প্রসঙ্গ। সেখানে এক দুষ্ট শিকারীর গল্প পাওয়া যায়। গভীর বনে বাঘের হাতে তার প্রাণ যায়। তার অশরীরী আত্মা উপদ্রবের কারণ হয়ে ওঠে। শান্তি আসে তখন, যখন কাক ওই মৃত শিকারীর একটি হাড় গঙ্গায় ফেলে দেয়। পুরাণ অনুযায়ী সঙ্গে সঙ্গে নাকি স্বর্গরথে চড়ে পুণ্যাত্মাদের বাসভূমে গমন করে পাপী শিকারী। এতটাই কাকের মহিমা।
ভূষণ্ডীর ত্রিকালজ্ঞ কাক তো হিন্দু পৌরানিক কাহিনির অন্যতম বিখ্যাত কাক। যে আবহমানকাল ধরে জীবিত। পৃথিবীর সমস্ত ঘটনা পরম্পরা দেখে আসছে সে। সব কালের সব কথাই তার জানা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে শ্রীকৃষ্ণ ভূষণ্ডীকে যুদ্ধের বিবরণ জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে সে বলেছিল, সত্যযুগের শুম্ভ-নিশুম্ভ যুদ্ধের সময় সে ছিল। কাকদের কাজই তো ময়লা-এঁটো খাওয়া। সেই যুদ্ধের সময়ও নিহত দৈত্যদের রক্ত-মাংস খেয়েছিল সে। তাতে তার খুব সমস্যা হয়নি। পরে ত্রেতাযুগে রাবণ বধের পর সেসব খেয়ে শেষ করতে তার একটু কষ্ট-ই হয়েছিল। তবু সে তা সামলে উঠতে পেরেছিল। তবে সবচেয়ে সবচেয়ে কষ্ট হয় এই দ্বাপরে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষে খাওয়া-দাওয়ার পর।
আরও শুনুন: মহাবীরের মৃত্যুশোকেই ভাইফোঁটার সূত্রপাত, জানেন এই কাহিনি?
বোঝাই যাচ্ছে, যে হিন্দু পুরাণে, মহাকাব্যে এবং লোককাহিনিতে কাক অপরিহার্য। তবু, কাক শুভ না অশুভ এ একটা প্রশ্ন। একদিকে যেমন, ‘কাকের মাংস কাক খায় না’ ধরনের প্রবাদ রয়েছে ছড়ানো। তেমনই কাকতাড়ুয়া ছাড়াও কিন্তু কৃষকের চলে না! অতএব, দ্বন্দ্বই হয়তো কাকচরিত্র।