বাতাসে আবিরের গন্ধ, কোকিলের গান। দখিন দুয়ার ধরে কবে যে বসন্ত টুক করে ঘরে ঢুকে পড়েছে বোঝাই যায়নি। তার মধ্যেই চোখ রাঙাতে শুরু করেছে গ্রীষ্ম। কিন্তু দোল মানেই যেন বসন্তের টিকিট কনফার্ম। ইতিমধ্যেই কেনা হয়ে গিয়েছে আবির, পিচকারি। আলমারি থেকে বেরিয়ে পড়েছে সব চেয়ে রং চটে যাওয়া জামা, পাঞ্জাবি। এ সবই রং খেলার প্রস্তুতি। গোটা ভারত জুড়েই রংয়ের উৎসব ঘিরে একই রকম উত্তেজনা। কোথাও লাঠমার হোলি তো কোথাও ফুলের দোল, কোথাও ফসলের উৎসব তো কোথায় বীরত্বের বন্দনা, আসুন শুনে নিই, দেশের কোথায় কী ভাবে পালন করা হয় এই হোলি বা দোল উৎসব।
‘দাদার কীর্তি’ ছবির সেই বিখ্যাত দোলের মুহূর্তটা মনে আছে নিশ্চয়ই। শিমুলতলার ছোট্ট একটা পাড়া। দু-দিক থেকে এসে মিলছে দুটো প্রভাতফেরি। একদিক দিয়ে আসছে বাঙালি পাড়ার রংমিছিল, অন্যদিক দিয়ে আসছে স্থানীয় ভোজপুরীদের দলটি। গান গাইতে গাইতে, বাতাসে আবির আর ফাগ ওড়াতে ওড়াতে এসে একজায়গায় মিলছে তাঁরা। বাঁধা হচ্ছে ঐক্যের সেতু। আসলে হোলি বা দোল মানেই বোধহয় তাই।
সারা দেশ জুড়েই হোলি আসলে মিলনের উৎসব। বাঁধ ভাঙার পার্বণ। দেশের নানা জায়গায় নানা ভাবে পালন করা হয় এই উৎসবটিকে। দোল উৎসবটিকে ঘিরে প্রায় সব জায়গাতেই মিশে থাকে রাধাকৃষ্ণের অনুসঙ্গ। বহু জায়গাতেই ফাল্গুন পূর্ণিমায় রাধাকৃষ্ণের পুজো দেওয়ার রীতি রয়েছে।
বাংলায় দোল মানেই যেমন বসন্তোৎসব, মহারাষ্ট্রে এ সময়টা পালন করা হয় শিগমা বা রঙপঞ্চমী। তার আগের দিন বিকেলে হোলিকা দহন বা ন্যাড়া পোড়া দিয়ে উৎসবের শুরু। অশুভকে হারিয়ে শুভ শক্তির সূচনা। পরের দিন রং, জল এসব দিয়ে শুরু হয় হোলি খেলা। স্থানীয়দের ভাষায় তাকে বলে ‘ধুমধাড়াকা’। পূরণ পোলি নামে একধরনের স্থানীয় খাবার মহারাষ্ট্রের এ সময়ের বিশেষত্ব। সেই প্রসাদ দেবতার পায়ে অর্পণ করেই শেষ হয় অনুষ্ঠানের ।
আরও শুনুন: রাধাকৃষ্ণের দোলকে আপন করে নিয়েছিলেন নবাবরাও, হোলিতে নাচতেন স্বয়ং ওয়াজেদ আলি শাহ
উত্তরপ্রদেশে এ সময়ে পালিত হয় লাঠমার হোলি। স্থানীয় ভাবে এই উৎসবকে হোলি মিলানও বলা হয়। উত্তরপ্রদেশের বরসনা, মথুরা ও বৃন্দাবন এলাকায়র মানুষ প্রতিবছর মেতে ওঠেন এক মজার উৎসবে। শুধু রং খেলাই নয়, এই উৎসবের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে মজার একটি রীতি। শুনলে অবাক হবেন, রীতিমতো লাঠিসোঁটা নিয়ে পুরুষের পিছনে এ সময় তাড়া করেন বাড়ির মহিলারা। মিছিমিছি নয়, সত্যিই মারধর করা হয়। মাথা বাঁচানোর জন্য পুরুষদের কাছে থাকে একটি ঢালও। সেই ঢাল মাথায় নিয়ে সার বেঁধে বসে থাকেন পুরুষেরা। তার উপর আছড়ে পড়ে মেয়েদের লাঠির ঝড়।
রাধাকৃষ্ণের আমল থেকে চলে আসছে এ রীতি। কথিত আছে, কৃষ্ণ নাকি একবার মা যশোদার কাছে গিয়ে সেই ঐতিহাসিক অভিযোগটি করে বসেছিলেন- “রাধা কিউ গোরি, ম্যায় কিউ কালা?” তখন রাধাকে রং মাখানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন মা যশোদা। যেমনি বলা তেমনি কাজ। বন্ধুবান্ধব নিয়ে রাধা ও অন্য গোপিনীদের ভাল মতোই রং মাখালেন কৃষ্ণ। ছাড়ার পাত্রী নন রাধাও। রেগেমেগে কৃষ্ণ ও তাঁর বন্ধুবান্ধবদের আচ্ছা করে লাঠি পেটা করলেন তিনি। সেই থেকেই লাঠমার হোলির প্রথা। প্রায় একসপ্তাহ আগে থেকে শুরু হয় তাঁদের এই উৎসব। বৃন্দাবনের বাঁকে বিহারী মন্দিরে ফুল দিয়ে হোলি খেলার রীতি রয়েছে। বারাণসীর ঘাটে হোলি উপলক্ষে রঙের উৎসবে মেতে ওঠেন বিধবা মহিলারাও।
আরও শুনুন: হোলিকা দহন থেকে মদনভস্ম, পৌরাণিক যে সব কাহিনিতে খোঁজ মেলে দোলযাত্রার
পঞ্জাবে আবার এ সময় পালিত হয় হলা মহল্লা উৎসব। হোলির ঠিক আগের দিন বীরত্বের উদযাপন করা হয় এই উৎসবের মাধ্যমে। মার্শাল আর্ট, ঘোড়ায় চড়া – এসবের মাধ্যমে শিখ যোদ্ধাদের নানা ভাবে শ্রদ্ধা জানানো হয় এদিন। পরে নাচ গান ও রঙে পালন করা হয় হোলির উৎসব।
গোয়ায় রঙের উৎসব পরিচিত শিগমো নামে। রং খেলার পাশাপাশি লোকগান ও পথনৃত্যের মাধ্যমে এই উৎসব উদযাপন করেন গোয়াবাসী। উদয়পুরে রাজকীয় ভাবে পালন করা হয় হোলির উৎসব। মেওয়ারের রাজ পরিবারে বরাবরই বড় করে পালন করা হয় এই উৎসব। দোলের আগের দিন এখানেও হোলিকা দহনের রীতি আছে। উত্তারাখণ্ডের কুমায়ুন অঞ্চলে পালন করা হয় কুমায়ুনি হোলি। এর সঙ্গে মূলত জড়িয়ে আছে কৃষিজীবি মানুষের উৎসব। নতুন বীজ বপণের ঋতুকে এর মাধ্যমে উদযাপন করেন মানুষ।
সব মিলিয়ে হোলির উৎসবের রংও দেশের বিভিন্ন কোণায় বিভিন্ন রকম। তবে সব উৎসবেরই গোড়ার কথা বোধহয় মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন। আর সেই কাজটা রঙের চেয়ে ভাল কে-ই বা করতে পারে বলুন তো!